ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামান ইনু

গাধার জেলবাস ও গর্দভকাহন

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

গাধার জেলবাস ও গর্দভকাহন

বিষয়টি অভূতপূর্ব এবং অগাধেয়। অভূতপূর্ব বলার কারণ এই যে, সেই বর্বর প্রস্তর যুগ হতে বর্তমান পারমাণবিক সভ্যতার ইতিহাসের আকাশে পাতিহাঁস হয়ে উড়ে বেড়ালেও এমন নজির খুঁজে পাবেন না। আর গাধাদের জীবন শাস্ত্র মোতাবেক অশাস্ত্রীয় বিধায় বলছি অগাধেয়। যদি মানবিকের বিপরীতে অমানবিক হয় তবে ঘটনাটিকে অগাধিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রাণী হিসেবে গাধা প্রভুভক্ত, অক্লান্ত পরিশ্রমী, এক কথায় মানবজাতির সেবায় উৎসর্গকৃত প্রাণ। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, মহামানবদের সেবায় তাদের ভূমিকা কম নয়। গোত্রপতি মোরিয়া পর্বতের উদ্দেশে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন গাধায় চড়ে (আদিপুস্তক ২২:৩)। মহাপুরুষদের বাহন হিসেবে বা তাদের প্রয়োজনে গাধার ব্যবহারের উদাহরণও আছে অনেক। অথচ গাধাদের এই প্রাণান্ত সেবার বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে তারা পেয়েছে কেবল উপহাস আর অবজ্ঞা। প্রাণীকুলের নিরীহতম এই সদস্যটিকে অকৃতজ্ঞ মানুষ উপস্থাপন করেছে নির্বোধের উদাহরণস্বরূপ। বাঙালী বালক মাত্রই শৈশব পাড়ি দিয়েছে কল্পনায় গাধার দু’কান টেনে। যা হোক, ধান ভানতে শিবের গীত বাদ দিয়ে ধানকাব্যে ফেরত আসি। ঘটনার ছানবিনান্তে যা জানা গেল তা এরূপÑ ঘটনাস্থল উত্তর প্রদেশের জালৌন জেলার ওরাই জেলের আবাসন চত্বরের সম্মুখবর্তী স্থান। জেল কর্তৃপক্ষ প্রায় ষাট হাজার রুপী ব্যয়ে সৌন্দর্য বর্ধনার্থে মূল্যবান বৃক্ষরাজি রোপণ করেছিল। সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আটটি গাধা। চোখের সামনে উপাদেয় খাবার দেখে ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি বলে আনন্দে আটখানা হয়ে তারা তা উদরস্থ করে ফেলে। অর সেখান থেকেই ঘটনা মোড় নেয় দুর্ঘটনায়। জেল পুলিশ বলে কথা, তারাই তো জেলের মালিক। গাধার এহেন বেয়াদবি তারা সইবে কেন? অতঃপর গাধাদের গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ! কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এভাবে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করা নিয়ে। গ্রেফতার না হয় করল, তাই বলে হাকিমের সামনে উপস্থিত না করেই সোজা জেলে! দুষ্টু লোকে যদি মহাভারতের মহান সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেন অবাক হওয়ার কিছু নেই। সংবিধান বলছে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাকিমের সামনে হাজির করা বাধ্যতামূলক। আর জেলে প্রেরণের এখতিয়ার কেবল হাকিমের। মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত গাধাদের হাকিমের সামনে হাজির করা হয়েছিল বলেও জানা যায়নি। তাই সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ করা যেতেই পারে। এই গ্রেফতার আইনসঙ্গত নয় বিধায় তাদের জামিন চাওয়ারও তো কোন উপায় ছিল না। চাইবে কি করে? তাদের তো আদালতেই হাজির করা হয়নি। আইনের এ ধরনের প্রয়োগের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই বোধ করি মহান সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স তার উপন্যাসের চরিত্রের মুখে বলেছিলেন... ‘ল ইজ আ এ্যাস।’ আইন যদি স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে তবে তাকে গাধা ছাড়া কি বলা যায়? ডিকেন্স এ্যান না বলে আ এ্যাস কেন বললেন সে বিচার ব্যাকরণবিদরা করুন। মহামতি ডিকেন্সের ব্যাকরণ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলব অত গাধা আমি অন্তত নই। এই গ্রেফতার ও জেলে প্রেরণ নিয়ে উঠে সমালোচনার ঝড়। এমতাবস্থায় জেলের বড় কর্তারা হাজির তাদের ব্যাখ্যা নিয়ে। তবে বড় কর্তাদের ব্যাখ্যা বিশ্বাস করার পূর্বে আরেকটি গল্প : অফিসের কাজে গাফিলতির জন্য বড় কর্তা বেশ রেগে আছেন মোখলেসের ওপর। মোখলেসকে ডেকে বললেন, ‘সব কাজই নষ্ট করে ফেলেছেন আপনি। এই অফিসে যে একটা গাধা আছে, আপনি জানেন?’ বড় কর্তার রুদ্র মূর্তি দেখে মাথা নিচু করে মোখলেস বলল, ‘না স্যার’। আরও ক্ষেপে গিয়ে বড় কর্তা বললেন, ‘নিচে কি দেখছ, আমার দিকে তাকাও!’ যাহোক বড় কর্তা নিয়ে কথা কম বলাই ভাল, আমাকেও তো করে খেতে হবে। তবে মূল্যবান বৃক্ষরাজি উদরস্থ করার পূর্বে গাধারা কোন এক বাঙালী কবি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের ‘মাণচিত্র ভক্ষণের হুমকি দিয়েছিল’ এমন অভিযোগ করেননি তাতেই বড় কর্তারা ধন্যবাদ পেতে পারেন। বড় কর্তা প্রসঙ্গ ছেড়ে দিয়ে বরং একটি সুসংবাদ দেই। চারদিন জেলবাসের পর গাধা আটটি সসম্মানে মুক্তি পেয়েছে। তাদের বেরিয়ে আসার দৃশ্য বোকাবাক্সের বদৌলতে দেখেছে সারাবিশ্ব। বিষয়টি এখানে শেষ হলে পারত। তা হয়নি। সমস্যা দেখা দিয়েছে এবার ওরাই জেলের কয়েদিদের নিয়ে। জেলখানায় একটি কথা প্রচলিত আছে- জেলমেট। যার অর্থ যে কয়েদিরা একসঙ্গে জেল খেটেছেন তারা পরস্পরের জেলমেট। ওরাই জেলের সে চারদিনের কয়েদিরা আশঙ্কা করছেন বাইরে বের হলে তাদের গাধার জেলমেট বলে অভিহিত করা হতে পারে। এই কলঙ্ক নিশ্চিতভাবেই তাদের বয়ে বেড়াতে হবে বাকি জীবন। এ অবস্থায় আমরা কেবল আশা করতে পারি আইন প্রয়োগকারীরা আরেকটু বেশি বিচার-বুদ্ধির পরিচয় দেবেন। এদিকে গাধা নিয়ে আরেক কা- ঘটিয়েছে রাজস্থান শিক্ষা দফতর। তাদের প্রকাশিত নবম শ্রেণীর হিন্দী পাঠ্য বইয়ে লেখা ছিলÑ ‘স্ত্রী থেকে গাধারা ভাল। কারণ গাধাকে খাবার খাওয়ালে সে সারাটা দিন ধরে কাজ করে। প্রভুর কথার অবাধ্য হয় না। এমনকি কোন অভিযোগও করে না। কিন্তু স্ত্রীরা তা করে থাকে!’ পাঠক রসগোল্লা চোখ নিয়ে ভাবছেন, এও সম্ভব? শুধু সম্ভব নয়, রাজস্থানের শিক্ষা দফতরের পরিচালক এ আর খান আবার এর সপক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন। তার ভাষায় মজাচ্ছলেই এই তুলনা টানা হয়েছিল! অধম বাকহারা। তারচেয়ে স্বামী-স্ত্রী ও গাধা নিয়ে একটি কৌতুক : চিড়িয়াখানার এক কোণে একটা মর্দা আর মাদি গাধা ঘাস খাচ্ছে। একটি ছোট ছেলে বড় গাধাটি দেখিয়ে তার বাবাকে বলল, ওটা কী বাবা? : ওটা একটা গাধা। : আর এটা? : এটা গাধার বউ। : তা হলে গাধারাও বিয়ে করে, তাই না বাবা? : হ্যাঁ বাবা, শুধু গাধারাই বিয়ে করে। আশার কথা এই যে, রাজস্থান শিক্ষা দফতর বিষয়টি পাঠ্যবই থেকে প্রত্যাহার করেছে। বিষয় যখন পড়াশোনা তখন এ কথা বলাই যায়, ছাত্রজীবনে গাধা সম্বোধিত হননি এমন মহাপুরুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আইনস্টাইন থেকে শুরু করে মায় এই অধম পর্যন্ত। অধমের বেলায় বিষয়টি কেবল গাধা সম্বোধনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অকারণে কিংবা বাংলা ব্যাকরণে অজ্ঞতার কারণে, গাধা পিটিয়ে মানুষ করতে অধমের জননীর প্রাণান্ত চেষ্টার কথা না বলাই ভাল! তার চেয়ে একটি গল্প বলি। ঘটনাটি আমেরিকার। মিঃ নাট পুত্র বল্টুকে প্রতিদিন একদফা উত্তম-মধ্যম শেষে কথার তীর ছুড়তেন এই বলে, ‘বল্টু তুই একটা গাধা। জানিস তোর বয়সে আব্রাহাম লিংকন প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা লেখাপড়া করতেন।’ নিত্য উত্তম-মধ্যমে অতিষ্ঠ, তিতিবিরক্ত বল্টু একদিন বাধ্য হয়েই বলল, ‘বাবা, আপনি কি জানেন আপনার বয়সে আব্রাহাম লিংকন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন!’ বেচারা বল্টু না হয় বেতের তোড়ে অতিষ্ঠ হয়ে ঠারেঠোরে কিছু একটা বোঝাতে চেয়েছিল। এদিকে অমিতব্যয়ী পিতার ঋণ শোধ করে করে অতিষ্ঠ চার্লস ডিকেন্স যে তার আইনজীবীকে ১৮৪২-এ লেখা এক পত্রে বাবা সম্পর্কে সরাসরি লিখেছিলেন, ‘বাবা একটা আস্ত গাধা’ সে বিচার কে করবে? উল্টো ১৪৫ বছর পর সে চিঠি নিলামে উঠছে। বিক্রেতারা আশা করছেন উচ্চমূল্য! বিষয় যখন প্রেসিডেন্টে ঠেকেছে তখন কান টানলে মাথা আসার মতো রাজনীতিও এসে পড়ে। রাজনীতি, রাজনীতিবিদ আর গাধা নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ হয়েছে এন্তার। পাঠক বোধ করি অবাক হচ্ছিলেন রাজনীতিবিদদের কনুই মারার এই মোক্ষম সুযোগ পেয়েও বিরত আছি বলে। আমার বিরত থাকার কারণ একেবারেই ভিন্ন। গাধা নিয়ে এ লেখা লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কেবল। এমন সময় বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি, এতদিন রাজনীতিবিদ আর গাধার তুলনা দিয়ে যত রঙ্গব্যঙ্গ হয়েছে তাতে গাধারা খুব বেশি মাইন্ড করেনি। তবে গোল বেঁধেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনীতিবিদ বনে যাবার পর। এরপর থেকে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যে কোন তুলনায় গাধা সমাজ চরম বিব্রত বোধ করছে। মাতৃদেবীর মতে আমি নিজেও তাদের স্বজাতি হওয়ায় নতুন করে বিব্রত হতে চাচ্ছি না। তাই রাজনীতিবিদদের রেহাই দেয়া। রাজকপাল জোরে এবারও বেঁচে গেলেন আর কি! যতটা মনে করা হয় গাধারা কি আসলেই অতটা নির্বোধ? একটা গল্প বলি, বিচারের ভার আপনার হাতে। গাধা আর ঘোড়ার বাতচিত চলছে : ঘোড়া বলল : আমরা মানবজাতির সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমরা তাদের কঠিন কাজগুলো করে দিয়ে তাদের জীবন সহজ করে দেই। যুদ্ধের সময়ও আমরা অপরিহার্য। সোজা কথা, মানবজাতির কর্মে, বিশ্রামে, যুদ্ধে আমাদের বিকল্প নেই। গাধার জবাব : বললেই হলো! দেখ, এক সময় মানুষ গাড়ি অবিষ্কার করবে, তৈরি করবে আধুনিক অস্ত্র। তখন তোমার প্রয়োজন আর থাকবে না। আর আমরা, গাধারা, মানবজাতির ভেতরে চিরকালই থাকব! ভাগ্যিস গাধারা মানুষের রঙ্গব্যঙ্গের খুব বেশি জবাব দেয় নাই! পাঠক, আসল কথা এখানেই- ‘গাধারা মানবজাতির ভেতরে চিরকালই থাকবে’। চারপেয়ে গাধা যদি কোনদিন এই গ্রহ থেকে বিলুপ্তও হয়ে যায় আর মানুষ টিকে থাকে, মানুষের মাঝে সে অর্থে তারাও ঠিক টিকে থাকবে। যারা মানবজাতিকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকির মুখে ফেলবে। শতকোটি আদম সন্তানকে অভুক্ত রেখে লিপ্ত হবে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায়। পৃথিবী নামক গ্রহটির পরিবেশ বিপর্যয় উপেক্ষা করে মঙ্গলের পরিবেশের অমঙ্গল রোধে ব্যয় করবে হাজার কোটি ডলার। জাতি-ধর্ম-বর্ণের নামে মানুষের রক্তে হোলি খেলায় মেতে উঠবে উন্মক্ত আক্রোশে। আর আমার মতো কেউ না কেউ লিখেই যাবে নিত্য-নতুন- ‘গর্দভকাহন’! লেখক : সাংবাদিক
×