ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঋণখেলাপীরা বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে’ -ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

‘ঋণখেলাপীরা বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে’  -ড. আর এম দেবনাথ

হাতের কাছে কয়েকটি খবর। প্রথম খবরটি একটি লিজিং কোম্পানির। এর নামোল্লেখ করলাম না। কারণ খবরটি নেতিবাচক। লিজিং কোম্পানিটি দেউলিয়াত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় খবরটি ব্যাংকের। এই খবরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ঋণখেলাপীরা ব্যাংকের টাকা মেরে দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় খবরটি নারী শ্রমিকদের ওপর। সঠিকভাবে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বিগত তিন বছরে হ্রাস পেয়েছে। চতুর্থ খবরটি চালের ওপর। দেশে যত চাল উৎপন্ন হয় তার মাত্র ৩৯ শতাংশ বাজারে আসে। বাকি চাল ব্যবহার হয় নানাভাবে। যেহেতু শেষের খবরটি কিছুটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে এবং বাকি তিনটা খবর নেতিবাচক। তাই প্রথমে ইতিবাচক খবরটার দিকেই নজর দিই। চাল বিষয়টি এখন বেশ আলোচনায়। কারণ দুইদিন পর পর ‘বিবিএস’ (ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস) এর ওপর নানা তথ্য দিচ্ছে। কয়েকদিন আগে বিবিএস বলেছে, বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে মাথাপিছু চালের ভোগ হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি গমের মাথাপিছু ভোগও হ্রাস পাচ্ছে। তাদের হিসাবকে আমলে নিলে চাল উৎপাদনের তথ্য, জনসংখ্যা, মাথাপিছু ভোগ, চাল-গম আমদানি ইত্যাদি তথ্যই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এমন কি প্রশ্নের সম্মুখীন হয় ‘বিবিএসের’ তথ্য গুণাবলীও। আমি আজ এসব বিষয়ে যাব না। আজকে বিবিএস বলছে, দেশে বিপণনযোগ্য চালের পরিমাণ হচ্ছে মোট উৎপাদনের মাত্র ৩৯ শতাংশ। এই পরিমাণ চালের ওপরই সারাদেশের চাল ভোক্তারা নির্ভরশীল। অর্থাৎ যারা চাল কিনে খায় সারা বছর তারা এর ওপর নির্ভরশীল। উৎপাদকরাই ভোগ করে প্রায় সাড়ে ৩৬ শতাংশ চাল। চালের মজুদ থাকে মোট উৎপাদিত চালের ১২ শতাংশ। এই তথ্যকে নির্ভরযোগ্য ধরে নিলে বিপদ একটা হয়। বিপুলসংখ্যক চাল ক্রেতা ও ভোক্তা যে চালের ওপর নির্ভরশীল তার পরিমাণ হয় খুবই কম। এতে তো বাজারে চালের দাম ভীষণ উর্ধমুখী হওয়ার কথা। সেই অনুপাতে বাজারে তো এত বড় উলম্ফন দেখা যায় না। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৪৬-৪৭ বছরে তো চালের দাম ‘রয়ে-সয়েই’ বাড়ছে। শত হোক চালের উৎপাদনে নিয়োজিত কত পরিবার। ‘বিবিএস’ বলছে অর্ধেকের মতো পরিবার চাল উৎপাদন করে। বাকিরা করে না। যারা চাল উৎপাদন করে তাদের অনেকেই আবার চাল কিনে খায়। কারণ তারা স্বাবলম্বী নয়। এমতাবস্থায় বিপুলসংখ্যক লোককে চালের জন্য বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর অর্থ দাঁড়ায় চালের ওপর চাপ বাড়বে এবং বাড়ছে। বিশেষ করে যখন জন্মহার বেশি, চালের উৎপাদন বৃদ্ধির হার কম। অধিকন্তু আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। এমতাবস্থায় চাল বিষয়টিকে আগামী দিনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করতে হবে। বিশেষ করে যখন চালের ওপর পরিসংখ্যানসমূহ কেন জানি মনে হচ্ছে বেশ গোলমেলে। এবার যাই নারী শ্রমিকদের তথ্যের ওপর। ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলমপমেন্ট স্টাডিজ’ নামীয় সরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে বিগত তিন বছরে দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০১৩ সালে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে শিল্প, ম্যানুফেকচারিং ও সেবা খাতে নারী শ্রমিক হ্রাস পেয়েছে, কেবল কিছুটা বেড়েছে কৃষিতে। কিছুটা বলছি কেন, প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে কৃষিতে। কিন্তু সার্বিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সার্বিকভাবে হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গার্মেন্টস খাতের ‘সাব-কনট্রাকটিং’কে। গার্মেন্টস খাতে কিন্তু কর্মসৃজনের সুযোগ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। খবরের কাগজে দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টসের মালিকরা ক্রমেই রোবটের দিকে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি বসাচ্ছে। এতে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। অথচ এই খাতেই গত কয়েক বছরে নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হয়েছে প্রচুর। ম্যানুফেকচারিং খাতেও এখন শ্রম নিয়োগের সম্ভাবনা ধীরে ধীরে কমে আসছে। কারণ মালিকরা প্রতিযোগিতার কারণে আধুনিক যন্ত্রপাতি বসাচ্ছে, যেখানে শ্রমিকের প্রয়োজন কম। দেশে বিশাল বিশাল ইকোনমিক জোন হচ্ছে, রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ জোন হচ্ছে। এসবে বিলিয়ন (শত কোটি) বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কতটুকু সৃষ্টি হচ্ছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। দৃশ্যত এসবই ‘পুঁজিঋণ’ শিল্প খাতে মানুষের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম। অথচ আমাদের দরকার হচ্ছে কর্মসংস্থান। দুনিয়ার সব দেশের মতো আমাদের দেশেও যদি ‘জবলেস গ্রোথ’ হয় তাহলে শ্রম আধিক্যের দেশ বাংলাদেশ দাঁড়াবে কোথায়? পাশের দেশ ভারতে ‘জবলেস গ্রোথ’ বিষয়টি বড় বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এখানেও তাই হওয়ার সম্ভাবনা। আমাদের বেকারত্বের হার পাকিস্তান থেকে কম হলেও এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কৃষিতেও এখন কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে। নারীরা কৃষিতে জড়িত হচ্ছে বেশি এটা ঠিক। কিন্তু পুরুষরা সব শহরমুখী হচ্ছে। পুরুষদের পুরো বছরের কর্মসংস্থান কৃষিতে হচ্ছে না। এটা সম্ভবও নয়। আমরা চেষ্টা করছি কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে। কিন্তু ছোট ছোট কৃষি ফার্মকে বাণিজ্যিকীকরণ কতটুকু কার্যকর হবে এই প্রশ্ন থেকেই যায়। কৃষিতে আমার মনে হয় দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনা দরকার। জমির ব্যবহার, জৈব সার ব্যবহার, গরুর ব্যবহার, গোবর ব্যবহার ইত্যাদির দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন চিন্তাভাবনা দরকার। জমির উর্বরতার অবস্থা কী তা বিশেষভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। বলাবাহুল্য, কৃষি এবং কৃষি সংক্রান্ত গ্রামীণ কর্মকা-ই কর্মসৃজন করতে পারে বেশি। শিল্পায়ন দরকার। কিন্তু যে ‘পুঁজিঋণ’ শিল্পায়নের দিকে আমরা পা বাড়িয়েছি সেই পথে কোটি কোটি লোকের কর্মসংস্থান কতটুকু সম্ভব তা সন্দেহাতীত নয়। বলা হচ্ছে স্টার্টআপের কথা। এর অর্থই যুবকরা বোঝে না। গ্রাম-গঞ্জে ‘স্টার্টআপ’ বলতে কী কী বোঝাবে তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলা দরকার। ওইসব ছোট ছোট কর্মকা-ে পুঁজি সরবরাহ কে করবে, কোত্থেকে পুঁজি আসবে, বাজারের ব্যবস্থা কে করবে তার ব্যাখ্যা দরকার। তাই নয় কী? নিবন্ধের শুরুতে যে বিষয়টির উল্লেখ করেছি সেই সম্পর্কে দুটো কথা বলা দরকার। মিডিয়া এতদিন শুধু সরকারী ব্যাংকের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছে। ওইসব ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়েই হয়েছে আলোচনা। তখন আমি বলেছি সরকারী খাতের ব্যাংকের ব্যবসা মোট ব্যাংক ব্যবসার ২০ শতাংশও নয়। আশি শতাংশ ব্যবসা যেখানে তাকেও আলোচনার মধ্যে আনা দরকার। আলোচনায় আনা দরকার বেসরকারী খাতের ব্যাংকের ব্যবসা, লিজিং কোম্পানির ব্যবসা এবং বীমা কোম্পানির ব্যবসা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আজ দেখা যাচ্ছে বেসরকারী খাতের ব্যাংক-বীমা এবং লিজিং ব্যবসার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিন এসব খবর ছাপা হচ্ছে। বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর মালিকানাতেও বড় বড় পরিবর্তন হচ্ছে। এসব পরিবর্তন ব্যাংকগুলোর সুশাসনের কোন ক্ষতি করছে কিনা তা মোটেই বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে ক্রমাগতভাবে খবর প্রকাশ হচ্ছে যে, ঋণখেলাপীরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। গত নবেম্বর মাসে চট্টগ্রামের বড় বড় ব্যবসায়ীর ওপর একটা স্টোরি একটা দৈনিকে ছাপা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা মেরে দিয়ে, ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে বড় ব্যবসায়ীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, দুবাই ইত্যাদি দেশে তারা চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। এদের বিরুদ্ধে মামলা আছে। মামলার শর্ত ভঙ্গ করে তারা দেশত্যাগ করতে সফল হয়েছেন। দেখা যাচ্ছে এই সমস্ত ব্যবসায়ীর কোম্পানিগুলো বেশ কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে ফতুর হয়েছে। কেউ ব্যবসায় লোকসান দিয়েছে, কেউ লাভ ও মূল নিয়ে দেশ ছেড়েছে। দেখা যাচ্ছে এটা একটা নতুন প্রবণতা। অথচ তাদের ধরে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। দেশে থাকলে তারা ‘রিট’ করে মামলা ঠেকিয়ে রাখে। ‘রিসিডিউল’ করে ঋণ ‘রিস্ট্রাকচার’ করে। এখন দেখা যাচ্ছে টাকা মেরে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান ঋণখেলাপ, খেলাপী টাকা অনাদায়, ঋণ ঘনঘন রিসিডিউলিং, ঋণ রিস্টাকচারিং, রিট করে মামলা আটকিয়ে রাখা, টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া, আবার এরই মধ্যে ব্যাংকের মালিকানায় বড় ধরনের পরিবর্তনÑ এসব ঘটনা কী ইঙ্গিত করে? এরই মধ্যে আবার নতুন ব্যাংকের অনুমোদন। পুরো বিষয়টিই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার নয় কি? এই খাতে ময়লা-ধুলা অনেক বেশি জমা হয়েছে। পরিষ্কারের কাজ প্রয়োজনীয় নয় কি? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×