ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপারেশনে কাটা পড়ে কণ্ঠনালী ॥ ভাষা হারান মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

অপারেশনে কাটা পড়ে কণ্ঠনালী ॥ ভাষা হারান মুক্তিযোদ্ধা

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ ভাষা নেই মুক্তিযোদ্ধা এফএফ আকরামুজ্জামানের মুখে। অনেক কথাই তিনি বলেন, কিন্তু এর একটিও ভাষা হয়ে তার কণ্ঠনালী দিয়ে বের হয় না। কারণ তার কণ্ঠনালীই যে কাটা পড়ে গেছে। এই অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন তিনি। অথচ সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলেই মুক্তিযোদ্ধা আকরামুজ্জামানকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব বলে জানালেন যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা এফএফ আকরামুজ্জামান যশোর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের মৃত আকবর আলী ও শরিফুন নেছার ছেলে। তার মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নং- ৪৩৭, লাল মুক্তিবার্তা নং ০৪০৫০১০৪৫০। মুক্তিযোদ্ধা আকরামুজ্জামানের বাড়িতে এই প্রতিবেদককে নিয়ে যান যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল। ইশারা-ইঙ্গিতে, কখন আঙ্গুল দিয়ে লিখে জানানোর চেষ্টা করতে থাকেন তিনি। জানান, ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল ও তিনি একই সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। সেই স্মৃতি মনে করে একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে ফিরে যান ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল। তিনি জানান, একাত্তরে সারাদেশের মতো যশোরেও মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোল বেজে ওঠে। জুন মাসের দিকে তারা ভারতে চলে যান। তিনি এবং আকরামুজ্জামান ভারতের বীরভূম জেলার রামপুরহাট ক্যান্টনমেন্টে তিন সপ্তাহের ট্রেনিং নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তারা সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে। ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব সেক্টরের অধীনে চৌগাছায় যুদ্ধ করেন তারা। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা অস্ত্র হাতে ছিলেন সম্মুখ সমরে। ২২ ও ২৩ নবেম্বর চৌগাছার গরিবপুরে ভয়াবহ যুদ্ধে তারা লড়াই করেছেন পাক হানাদারদের সঙ্গে। ৩ ও ৪ ডিসেম্বর মুক্তিনগরের যুদ্ধেও অংশ নেন তারা। এরপর আফজাল হোসেন দোদুল ফিরে আসেন বর্তমানে। জানান, যুদ্ধের আগে আকরামুজ্জামান নওয়াপাড়া জুটমিলের শ্রমিক ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ফিরে এসে ট্রাক চালাতেন। এভাবেই জীবন-জীবিকা চলছিল। বিপত্তি বাধে ২০০৩ সালের দিকে। গলায় টিউমার হয় আকরামের। টিউমার অপারেশন করতে ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে অপারেশনে কাটা পড়ে তার কণ্ঠনালী। কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। সেই সময় ওই হাসপাতাল থেকে তাকে বলা হয়েছিল, এক বছর পর ২৫ হাজার টাকা ব্যয় করলে অপারেশন করে তাকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে। কিন্তু ওই টাকা আর জোগাড় হয়নি। চিকিৎসাও হয়নি তার। মুক্তিযোদ্ধা আকরামুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কণ্ঠনালী কাটা পড়ায় গলায় একটি ছিদ্র হয়ে আছে। কথা বলার চেষ্টা করলেও কোন শব্দ বের হয় না। খাবার খাওয়ার সময় ওই ছিদ্রে একটি ক্যাপ লাগিয়ে নিতে হয়। না হলে খাবার বেরিয়ে যায়। ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল জানালেন, এখনও চিকিৎসা করলে আকরামকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এজন্য হয়তো লাখ খানেক টাকা দরকার। কিন্তু এ টাকা সংস্থানের কোন উপায় তার নেই। ছেলেদের সংসারে থেকে ভাতার টাকায় কোনমতে জীবন চলে তার। তাই চিকিৎসা সহায়তার জন্য কয়েকবার মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করা হয়েছে, কিন্তু সাড়া মেলেনি। বিদায় বেলায় ইশারায় মুক্তিযোদ্ধা আকরামুজ্জামান জানালেন, গলার অপারেশন করে সুস্থ হতে চান তিনি। ফিরে পেতে চান কথা বলার ক্ষমতা। আর নতুন প্রজন্মকে শোনাতে চান যুদ্ধ জয়ের গল্প।
×