ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মনিকার মনের কথা...

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

মনিকার মনের কথা...

বাংলাদেশ দলের আশা-ভরসার প্রতীক মনিকা চাকমা। বল নিয়ে দ্রুতগতিতে ড্রিবলিং করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। খেলতে পারে দুই পায়েই। শূটিং, পাসিং, হেড, বল কেড়ে নেয়া... সবক্ষেত্রেই কোচের ফুল মার্কস তার ঝুলিতে রুমেল খান ॥ মোটু এবং পাতলু নামের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাস করে ফুরফুরি শহরে। স্বভাবে উভয়েই হাসিখুশি। কিভাবে নিজেদের ভাগ্যের উন্নতি করা যায় তা নিয়েই বন্ধু যুগলের ধ্যানজ্ঞান। শিঙ্গাড়া মোটুর প্রিয় খাবার। শহরের সেরা শিঙ্গাড়া পাওয়া যায় চা-ওয়ালার দোকানে। মোটু সবসময় সেই দোকান থেকে বিনে পয়সায় শিঙ্গারা খাওয়ার ধান্ধায় থাকে। বেশিরভাগ সময়ই মোটু কোন না কোন সমস্যা তৈরি করে যেটি পাতলু সমাধান করে। মোটু পাতলু হলো ভারতের সিজিআই টেলিভিশন এ্যানিমেটেড কার্টুন সিরিজ। পাঠক নিশ্চয়ই ভ্রƒ কুঁচকে ভাবছেন খেলার পাতায় হঠাৎ কার্টুন নিয়ে মাতামাতি কেন? মাতামাতির কারণÑ এই কার্টুনটি অসম্ভব প্রিয় বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৫ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের এক খেলোয়াড়ের। নামটি তার যেমন মিষ্টি, চেহারাটাও দারুণ মিষ্টি। মনিকা চাকমা। খেলে এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পজিশনে। বাংলাদেশ দল চলমান সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ইতোমধ্যেই ফাইনাল খেলা নিশ্চিত করেছে। টানা দুই ম্যাচে তারা হারিয়েছে যথাক্রমে নেপালকে ৬-০ এবং ভুটানকে ৩-০ গোলে। প্রথম ম্যাচে নেপালকে হারানোর পথে হ্যাটট্রিক করে বাংলাদেশের ফরোয়ার্ড তহুরা খাতুন। কিন্তু তহুরা ম্যাচসেরার পুরস্কার পায়নি। পেয়েছে মনিকা। কারণ পুরো ম্যাচে অসাধারণ প্লে-মেকারের ভূমিকা পালন করে সে। নিজে তো একটি গোল করেই, অন্যদের দিয়ে করায় আরও দুটি গোল। এছাড়া তার নেয়া দুটি শট নেপালের পোস্টে লেগেও ফিরে আসে। ওই ম্যাচে মনিকার গোলটি ছিল কর্নার থেকে। বাংলাদেশ দলের আশা-ভরসার অন্যতম প্রতীক মনিকা। বল নিয়ে দ্রুতগতিতে চমৎকার ড্রিবলিং করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। খেলতে পারে দুই পায়েই। শূটিং, পাসিং, হেডিং, বল কেড়ে নেয়া... সবক্ষেত্রেই কোচের ফুল মার্কস পাবে সে। সে কারণেই কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের প্রথম একাদশে বরাবরই থাকে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এই ধরণীতে আসা মনিকার নামটি। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত ড্রিবলিং করায় প্রতিপক্ষ প্রায়ই মার্কিং এবং ফাউল করে থাকে মনিকাকে। ফলে চোট পাবার আশঙ্কা থাকে। ভয় করে না? ‘না, মাঠে নেমে বল পেলে আমার আর কোন হুঁশ থাকে না। ভুলে যাই প্রতিপক্ষ লম্বায় আমার চেয়ে উঁচু, ওজনে আমার চেয়ে বেশি, ফাউল করে ফেলে দেবে আমাকে। আমার লক্ষ্য থাকে কাটিয়ে গোল করার বা নিজ দলের কাউকে বলটা পাস দিয়ে দেয়া।’ মনিকার ভাষ্য। খাগড়াছড়ির সুমন্তপাড়ার কৃষক বিন্দু কুমার এবং গৃহিণী রবি মালার পাঁচ সন্তানের সবাই মেয়ে। এদের সবার ছোট ও আদরের নয়নমণি সুদর্শনা মনিকা। তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরুর গল্পটা কেমন? লাজুক হাসি হেসে মনিকার স্মৃতিচারণ, ‘কেন যেন ফুটবল খেলাটা খুব ভাল লাগতো। আশেপাশের সবাইকে দেখতাম খেলছে। আমারও শখ হলো খেলব। কিন্তু বাবা মানা করতেন। রাগ করে বলতেন, এসব খেলা না খেলে যেন মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করি। কিন্তু ঠিকই লুকিয়ে আশেপাশে খেলতে চলে যেতাম। ছেলেদের সঙ্গেই বেশি খেলতাম। তখন ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ি।’ রাঙামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এখন দশম শ্রেণীতে পড়ে মনিকা। মনিকা যে প্রতিভাময়ী ফুটবলারÑ এটা প্রথম আবিষ্কার করেন তার স্কুল শিক্ষক বির সেন। তার তত্ত্বাবধানেই ২০১২ সালে মনিকা অংশ নেয় বঙ্গমাতা ফুটবলে, লক্ষ্মীছড়ির মরা চেংগী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে (বোন অনিকা চাকমাও খেলে)। সেবার দলটি জেলা পর্যায় পর্যন্ত খেলে। পরের বছর খেলে বিভাগীয় পর্যায়ে। ২০১৫ সালে বাফুফের ‘প্ল্যান অ-১৫ বালিকা ট্যালেন্ট হান্ট’ ফুটবল কার্যক্রমের মাধ্যমে দৃশ্যপটে আসে মনিকা। ডাক পায় বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে। এ পর্যন্ত সে খেলেছে অ-১৪ ও অ-১৬ দলে। এখন খেলছে অ-১৫ দলে। তার আন্তর্জাতিক গোল চারটি। মজার ব্যাপার, সবগুলোই নেপালের বিরুদ্ধে। এএফসি অ-১৪ আঞ্চলিক আসরে ৩টি এবং একটি চলতি সাফ অ-১৫ আসরে। তোমার প্রিয় প্রতিপক্ষ কি নেপাল নাকি? ‘হি হি হি। লিখে দিতে পারেন।’ মনিকার প্রাণখোলা হাসি। এর আগে জাতীয় মহিলা দলে খেলেছেন তৃষ্ণা চাকমা। এরপরেই কী মনিকা? কেননা এখনও সিনিয়র জাতীয় দলে খেলা হয়নি তার। ‘আশা করছি খুব শীঘ্রই জাতীয় দলে ডাক পাব এটা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন।’ মনিকার আশাবাদ। লিওনেল মেসি এবং সাবিনা খাতুনের গুণমুগ্ধ মনিকা এ পর্যন্ত ফুটবল খেলার সুবাদে সফর করেছে তাজিকিস্তান, নেপাল, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ড। ফুটবল খেলে যে সুনাম পেয়েছে তা সে টের পায় ছুটিতে নিজ এলাকায় গেলে, ‘আশেপাশের সবাই খুব প্রশংসা করে, উৎসাহ দেয়।’ জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকার সময়টা কিভাবে কাটে? ‘আমরা বেশ মজা করি। হাতাহাতি, চুলাচুলিও করি। তবে সিরিয়াসলি নয়, মজা করে।’ মনিকার উত্তর। কোচ ছোটনের ভূয়সী প্রশংসা করে মনিকা, ‘ছোটন স্যারের কাছে অনেক কিছু শিখেছি, এখনও শিখছি। তিনিই আমাকে আগ্রাসী মুডে খেলার জন্য তৈরি করেছেন।’ আজ বাংলাদেশের শেষ লীগ ম্যাচ শক্তিশালী ভারতের বিরুদ্ধে। মনে হয়েছে ফিজিক্যাল ফিটনেসে ভারত এগিয়ে। বাংলাদেশ কি পারবে? ‘কেন নয়? আমরা ওদের মোটেও ভয় পাই না। এর আগে অ-১৪ আসরে ওদের আমরা দুবার হারিয়েছি। এবারও হারাব।’ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ মোটু পাতলুর মহাভক্ত মনিকার। পারবে কি মনিকারা আজ?
×