ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষসেরা টেলিফিল্ম

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

বর্ষসেরা টেলিফিল্ম

প্রতিনিয়ত সবার মুখে একটি বুলি আমরা প্রায়ই কমবেশি শুনে থাকি। আমাদের দেশের নাটক-টেলিফিল্ম ভাল হয় না। গল্পের অভাব, দক্ষ নির্মাতার অভাব। যার কারণে আমাদের দেশের দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয় বাংলা নাটক টেলিফিল্মের উপর থেকে। ক্রমেই তারা বিদেশী সিরিয়ালের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এমন সঙ্কটময় সময় তরুণ দুই নির্মাতা মিজানুর রহমান আরিয়ান এবং মাবরুর রশীদ বান্নাহ গতানুগতিক ধারার বাইরে বেরিয়ে নির্মাণ করেন আমাদের সমাজের ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা নিয়ে বড় ছেলে এবং আমাদের গল্পটা এমনও হতো পারত শিরোনামের দুটি টেলিফিল্ম। ছোটপর্দার দুঃসময়ে তৃপ্তি দিল ‘বড় ছেলে’ ও আমাদের গল্পটা এমনও হতে পারত। যা দর্শক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দেয় টেলিফিল্ম দুইটি। জি বাংলা, স্টার জলসা আর স্টার প্লাসের ভিড়ে বাংলাদেশে যে এখনও নাটক আর টেলিফিল্ম টিকে আছে সেটা এদের মতো তরুণ প্রতিভাবান নাট্যকারদের সুবাদেই। এই টেলিফিল্ম দুইটির মাধ্যমে আমাদের টিভি নাটকের যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তাই বলতে পারি এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত বর্ষসেরা টেলিফিল্ম হলো মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘বড় ছেলে’ এবং মাবরুর রশীদ বান্নাহর আমাদের গল্পটা এমনও হতে পারত। জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়। অপূর্ব ও মেহজাবিন অভিনীত বড় ছেলে টেলিফিল্মটি অনলাইন অফলাইন সবখানেই বেশ সাড়া ফেলে। খুবই সাধারণ একটি মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প নিয়ে টেলিফিল্মটি রচনা করেছেন নির্মাতা নিজেই। নাটকের গল্পে এসেছে মধ্যবিত্ত জীবনের গতানুগতিক একটি গল্প। এর বাইরে মূল বিষয় ছিল একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ‘বড় ছেলে’র ভূমিকা। বড় ছেলে কি কি স্যাক্রিফাইস করতে পারে কিংবা করতে হয়। এ গল্পই সব ধরনের দর্শককে আকর্ষণ করেছে। টেলিভিশন চ্যানেল দর্শকদের অনুরোধে টেলিফিল্মটি পুনরায় প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রচারিত হয়। গল্পটি একান্তই আপন একটি খুব কাছের একটি গল্প। আমাদের খুব নিকট দিয়ে যাওয়া বস্তুটিকে হয়ত আমরা দেখতে পারি না। নির্মাতা এই বিষয়টিই দেখানোর চেষ্টা করেছেন এবং বলা যায় তিনি সফল হয়েছেন। পরিবারের বড় ছেলেদের নানা দায়িত্ব থাকে। বাবার পরেই সংসারের হাল বড় ছেলেকে ধরতে হয়। এখানে পাওয়া না পাওয়ার অনেক বিষয় থাকে। তারপরেও বড় ছেলেকে নিজের দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে হয়। প্রয়োজনে অনেক স্যাক্রিফাইসও করতে হয়। এই নাটকে বড় স্যাক্রিফাইস দেখিয়েছেন অপূর্ব। নিজের চাকরি না হওয়ায় শুধু পরিবারের কথা ভেবে প্রেমিকাকে বিসর্জন দিয়েছেন। আর ‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্মে মেহজাবিনকে অভিনেত্রী হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন দর্শকরা। মেহজাবিনের অভিনয়ের বিষয়ে যারা সন্দিহান ছিলেন, তাদের সেই সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। বলা যায় মেহজাবিনের অভূতপূর্ব অভিনয়ে দর্শকরা মুগ্ধ। এই অল্প কথাতে মেহজাবিনের প্রাপ্য কৃতিত্ব দেয়া হবে না। মেহজাবিনের কান্না অজ¯্র দর্শকের চোখে কান্না এনেছে। মেহজাবিন নিজে কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন স্ক্রিনের সামনের শত শত মানুষের। টেলিফিল্মটিতে চমৎকার একটি গান পেয়েছে দর্শকরা। বলা যায় দর্শকরা এখন ‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্ম ব্যবহৃত গানের বড় শ্রোতা। শহরে বন্দরে, বাসা বাড়িতে এখন ‘এই ঠুনকো জীবনে তুমি কাচের দেয়াল...’ বেজে যাচ্ছে। এই গানের মাধ্যমে কণ্ঠশিল্পী মিফতা জামান নতুন একটি বড় ধরনের শ্রেণীর কাছে পরিচিতি পেয়েছেন। নির্মাতারা সাধারণ নাটকের পেছনের মানুষ। ‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্মের মাধ্যমে মিজানুর রহমান আরিয়ান পরিচিতি পেয়েছেন একটি নতুন শ্রেণীর নিকট, যারা নির্মাতা সম্পর্কে তেমন মাথা ঘামাতেন না। দর্শকর সমান প্রশংসা পেয়েছেন নির্মাতা আরিয়ান। প্রতিটি মধ্যবিত্ত সন্তানের জন্য বড় সত্য, বড় বাস্তব এই শব্দগুলোÑ ‘রাশেদরা চোখের পানি মুছে ফেলে। তারা জানে ঘরের বড় ছেলেকে এভাবে কাঁদতে হয় না, কাঁদতে হয় লুকিয়ে আড়ালে যেন কেউ না দেখে। চোখের পানি মুছে তাদের ঘরে ফিরতে হয় কিছু মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, তাদের শক্তি হওয়ার জন্য।’ রাশেদরা ভাল থাকুক যে রাশেদরা পরিবারের বাবা-মা-ভাই-বোনগুলোর নির্ভরতা আর ভরসা হয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে যাচ্ছে চুপচাপ নিজেকে বিসর্জন দিয়ে, প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত! বড় ছেলের সাফল্য শেষ হতে না হতেই আর এক জনপ্রিয় তরুণ নির্মাতা মাবরুর রশীদ বান্নাহ ইরফান সাজ্জাদ, সাফা কবির ও মুনিরা মিঠুকে নিয়ে নির্মাণ করেন আমাদের গল্পটা এমনও হতে পারত। গ্রামের কোন ছেলে যখন চাকরির উদ্দেশ্যে শহরে পাড়ি জমায় তখন তার বুকে থাকে একরাশ স্বপ্ন। আর আড়ালে থাকে তার মমতাময়ী মায়ের দুঃখসহ আরও অনেক কিছু। নাটক-সিনেমাগুলোতে বেশিরভাগ সময়ই অতিপ্রাকৃত বিষয় দেখানো হয়। যা বাস্তবে কখনও সম্ভব হয় না। কিন্তু নাটক তো জীবন থেকেই নেয়া। মায়ের কান্না, গ্রাম ছেড়ে অচেনা শহরের অভিজ্ঞতা, জীবন ধারণের জন্য কষ্টের মতো জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা ছোট ছোট অসংখ্য গল্প নিয়েই সাজানো হয়েছে টেলিফিল্ম ‘আমাদের গল্পটা এমনও হতে পারত।’ আর এই টেলিফিল্মটি নির্মাণ করেছেন গতানুগতিকতার বাইরের তরুণ নির্মাতা মাবরুর রশীদ বান্নাহ। চাকরি যেন সোনার হরিণ, এই নগরে ভোট চেয়ে পোস্টার ছাপানো যায় কিন্তু পড়াতে চাই ছাপানো যায় না, ছাপিয়ে কোন লাভও হয় না। এক মুঠো স্বপ্ন পুঁজি করে দিন গুনতে থাকে ছেলেটি। আজ না হয় কাল, কাল না হলে পরশু একদিন আমি চাকরি পাবই। অসুস্থ মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসব। স্বপ্ন সাজাতে যেয়ে শব্দের মেলা বসে যায়, গল্প তৈরি হয় নিজের অজান্তেই। বাস্তবতা কি কল্পনার মতোই মধুর হয়? বাস্তবতা মুদ্রার উল্টা পিঠ দেখায়। পৃথিবীর যাবতীয় ব্যর্থতা ঘাড়ে চাপিয়ে একটা বিশাল আক্ষেপ নিয়ে চলতে হয় আমাদের। কখনও সে ব্যর্থতা মায়ের লাশ বহনের মতোও ভারি হয়ে যায়। তবুও চলতে হয়, চালিয়ে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। আমরা চালিয়ে যাই, বুকের পাহাড়ে আক্ষেপ প্রতিধ্বনিত হয়, ‘আমাদের গল্পটা এমনও হতে পারত’। এমনই একটি আক্ষেপের গল্প নিয়ে মাবরুর রশীদ বান্নাহর টেলিফিল্ম ‘আমাদের গল্পটা এমনও হতে পারত।’ আমাদের গল্পটা এমনও হতে পারত- শুধু কোন টেলিফিল্ম নয়, এটা হতে পারে আপনার আমার আয়না। যেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের দেখতে পাই। গল্পগুলো এমন না হয়ে অমন হওয়ার আক্ষেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন অথবা বুকের ভেতর কোথাও একটু খালি জায়গা অনুভব করতে পারেন। আনন্দকণ্ঠ ডেস্ক
×