ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

-সাজু আহমেদ

যাত্রাশিল্প রক্ষায় পৃথক যাত্রা একাডেমি প্রয়োজন ॥ হাসান কবির শাহীন

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

যাত্রাশিল্প রক্ষায় পৃথক যাত্রা একাডেমি প্রয়োজন ॥ হাসান কবির শাহীন

এ্যাডভোকেট হাসান কবির শাহীন। যাত্রা সংগঠন জয়যাত্রার প্রতিষ্ঠাতা ও দলপ্রধান। যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে সমমনা কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ যাত্রা ফেডারেশন। তিনি এ সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল। সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে যাত্রা ফেডারেশনের দ্বিতীয় জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাউন্সিল ও যাত্রাশিল্পের মান উন্নয়ন এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। যাত্রাশিল্পের সাম্প্রতিক অবস্থায় আপনার বক্তব্য কী? হাসান কবির শাহীন : আমি মনে করি যাত্রা শিল্প বদলাবার এবং বদলে দেয়ার এখনই সময়। যাত্রা শিল্পকে রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া সময় এসেছে। যাত্রা শিল্পের অঙ্গনকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে আমরা সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি দাওয়া পেশ করেছি। আমরা মনে করি যাত্রা বিলুপ্তি হয়নি। যাত্রা লোকশিল্প, মানবতার শিল্প, এটা সমাজের শিল্প যেমন উঁচু তলার মানুষের শিকড়ের গল্প তেমনি নিচুতলার মানুষের গল্প। বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম অংশ যাত্রা। যাত্রাপালার শুরুতে দেশাত্মবোধক গান, পালার আত্মকথা এবং দীর্ঘ সময় ব্যাপ্তি এর নানা ধরনের আবহ কখনও মানুষকে হাসায়, কখনও মানুষকে কাঁদায় আবার কখনও বা দর্শকদের ভাবায়, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরে। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে রক্ষা করতে হবে। গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত আর তাদের গডফাদার আজ যাত্রার নামে নানা অপকর্ম করছে। তাদেরই যাত্রার মুখপাত্র ভাবছেন অনেকেই। তাদের আইনীভাবে প্রতিরোধ করে প্রকৃত যাত্রাশিল্পের বিকাশের পথকে সুগম করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আইন করে এই দুর্বৃত্তদের নির্মূল করতে হবে। যাত্রাশিল্প তার ঐতিহ্য হারাল কিভাবে? হাসান কবির শাহীন : যাত্রাশিল্প সমাজ ও জাতিকে স্বকীতায় এবং সমৃদ্ধিতে উজ্জীবিত করেছে, আন্দোলিত করেছে, সেই শিল্প আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে বলা যায় অনেকটাই মৃত্যুর দরজায় । অশ্লীলতা, নগ্নতা, অহেতুক হৈ-হুল্লোড়, যাত্রার প্রধান বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুন্ন করেছে। এক সময়ে যাত্রা সপরিবারে উপভোগের বিষয় ছিল আজ তা নেই। সমাজের একটা বড় অংশ যাত্রা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হতাশার চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে আজ ক্লান্ত যাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পী, কলাকুশলী, হতাশার ক্রান্তিলগ্নে যাত্রাশিল্প। যাত্রাশিল্পের এ দুর্দশার কারণ কী বলে মনে করেন? হাসান কবির শাহীন : আবহমান বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে যাত্রাশিল্প আজ ধ্বংসের দোঁর গোড়ায়, যাত্রা শিল্পীদের আর্থিক অসচ্ছলতা, আকাশ সংস্কৃতির অবাধ বিচরণ; দ্বৈত উদ্যোক্তা ও সংগঠনের অভাব; রাজনৈতিক কারণ; মাদকাসক্তির কারণে অনিয়ন্ত্রিত যুব সমাজ; প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ক্ষেত্র না থাকা; নারী শিল্পীদের অবকাঠামোগত সুবিধার অপ্রতুলতা; নিয়মিত গবেষণা ও বিশ্লেষণ করার মতো রিসোর্স সেন্টার না থাকায় এই শিল্পের প্রতি এক শ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসন ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সমম্বয়হীনতাও অনেকাংশে দায়ী। স্বাধীনতার পড়ে ৮০ দশকের কাছাকাছি থেকে যাত্রাপালাকে এক জঘন্য অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর দুর্দশার জন্য যাত্রা সংশ্লিষ্টরাই দায়ী বলে আমি মনে করি। এ অবস্থায় যাত্রা ফেডারেশনের দাবি কী? হাসান কবির শাহীন : ফেডারেশনের দ্বিতীয় সম্মেলনে যাত্রা শিল্পের উন্নয়নে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে নিকট আমরা আমাদের দাবিগুলো তুলে ধিেছ। আমাদের দাবিগুলো মধ্যে রয়েছে যাত্রাকে সান্ধ্যকালীন করা, জেলা উপজেলা ও মহানগরে যাত্রা প্রদর্শনীর অনুমতি সহজতর করা, সরকারের গঠিত যাত্রাশিল্প উন্নয়ন কমিটিতে যাত্রা ফেডারেশনের সভাপতি ও সম্পাদককে অন্তর্ভুক্ত করণ, যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০১২ এর ক্রমিক ১০ (১) ও ১০ (৩) পরিবর্তন করে শিল্পে অশ্লীলতা প্রদর্শনকারীদের বিচারের জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মহান জাতীয় সংসদের হস্তক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মৌসুমে নিবন্ধিত যাত্রাদলগুলোর কার্যক্রমে সরকার গঠিত যাত্রাশিল্প উন্নয়ন কমিটির মনিটরিং ব্যবস্থা জারদারসহ যাত্রা মঞ্চে অশ্লীলতাকারী মালিক, শিল্পী, আয়োজকসহ সকল দুর্বৃত্তকে নীতিমালা ১০ (১) ও ১০ (৩) সংশোধনের পূর্ব পর্যন্ত প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষমতা আইনে শাস্তিদান, অভিযুক্ত দল এবং শিল্পীকে কালো তালিকাভুক্ত করা। নিবন্ধিত দলগুলোকে পুনরায় যাচাইকরা।নিবন্ধিত দলগুলোকে ব্যাংক ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। প্রতিবছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক উৎসব আয়োজ, নির্মল দলগুলোকে শর্তহীন অনুদান,প্রতি বছর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন শিল্পী তৈরি করা, পালা রচনায় অনুদান প্রদান। বিটিভিসহ অন্য চ্যালেনগুলোতে পালা সম্প্রচারের ব্যবস্থা। শিল্পকলা এবং প্রতি জেলা-উপজেলায় যাত্রার জন্য সরকারী হল বা অডিটরিয়াম সংরক্ষিত রাখা। শিল্পকলা একাডেমিসহ জেলায় যাত্রা মঞ্চ তৈরি, পেশাদার যাত্রাশিল্পীদের নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থাসহ ষাটোর্ধ শিল্পীদের পেনশন প্রদান। সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তিতে যাত্রাকে অন্তর্ভুক্তকরণ। যাত্রাশিল্প রক্ষা এবং এর কল্যাণে পৃথক যাত্রা একাডেমি গঠন প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকার গাঠিত যাত্রা শিল্প উন্নয়ন কমিটিকে পুনর্গঠন, যাত্রা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৃত সংগঠকদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং যাত্রা ফেডারেশনের সভাপতি ও সম্পাদককে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। যাত্রাশিল্প নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? হাসান কবির শাহীন : আমরা সুস্থ যাত্রা চর্চার মাধ্যমে যাত্রাশিল্পের হারানো পুনরুদ্ধার করতে চাই। যাত্রাশিল্পী এবং সংগঠকদের পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে দিতে চাই। সর্বোপরি যাত্রাশিল্পকে নিয়ে অনেক দূর যেতে চাই।
×