ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভাবশালী চক্র সম্পদ উধাও করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে ॥ যে সম্পদ আছে তা দিয়ে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ সম্ভব

যুবকের আমানতকারীরা ১০ বছরে কানাকড়িও ফেরত পাননি

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

যুবকের আমানতকারীরা ১০ বছরে কানাকড়িও ফেরত পাননি

এম শাহজাহান ॥ গ্রাহক ঠকানো কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হওয়ার দশ বছরে কানাকড়িও ফেরত পাননি যুবকের ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীরা। স্থাবর-অস্থাবরসহ বর্তমান বাজারমূল্যে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এখন এই সম্পদও উধাও করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে একটি প্রভাবশালী চক্র। এ বিপুল সম্পদ থাকার পরও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পাওনা আড়াই হাজার কোটি টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া সংস্থাটির সম্পদের হিসাব নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। বিভ্রান্তির কারণে গ্রাহকদের পাওনা মেটানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। এতে করে যুবকের সাড়ে ৩ লাখ গ্রাহকের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। এদিকে, যুবক বিষয়ে সরকার গঠিত প্রথম কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে জারি করা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন স্থানে কেনা জমি গোপনে বিক্রি করে দিয়েছে সংস্থার কর্তৃপক্ষ। জমি বিক্রির চাঞ্চল্যকর আরেক দফা প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়েছে সর্বশেষ গঠিত রফিকুল ইসলাম কমিশনের কাছে যুবক কর্তৃপক্ষের দেয়া হিসাব থেকে। সাড়ে তিন লাখ গ্রাহকের আমানতের অর্থে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৭৪ একর জমি কেনা হয়। এ জমির হিসাব উঠে আসে যুবক সংক্রান্ত সরকার গঠিত ড. ফরাসউদ্দিন কমিশনের (প্রথম কমিশন) তদন্তে। কিন্তু রফিকুল ইসলাম কমিশনের (দ্বিতীয় কমিশন) তদন্তে যুবকের স্থাবর ও অস্থাবর মিলে মোট ৫১৮ একর জমির সন্ধান পাওয়া যায়। তবে ‘যুবকের ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটি’র অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, ২ হাজার ২৬৮ একর শুধু জমিই আছে। নামে-বেনামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও সম্পদ রয়েছে সংস্থাটির। এছাড়া ১৫৬ একর জমির হিসাব দ্বিতীয় কমিশনকে দেয়া হয়নি। এই ১৫৬ একর জমির মধ্যে ১১৬ একর জমির ব্যাপারে যুবক কর্তৃপক্ষ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে কমিশনকে। সেখানে বলা হয়েছে, এই জমি বর্তমানে আর অবশিষ্ট নেই। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি এক অনুষ্ঠান শেষে জনকণ্ঠকে বলেন, সংস্থাটির সম্পদের কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা মামলা করলে আদালতের মাধ্যমে একটি রায় আসবে। ওই রায়ের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। এদিকে, কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পর যুবককে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধ ও হয়রানি বন্ধ, সম্পত্তি হস্তান্তর স্থগিতাদেশ ও প্রশাসক নিয়োগ করে স্থায়ী সমাধানের জন্য ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাবেক গবর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে কমিশন প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে যুবকের সব সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নিয়ে তা বিক্রির মাধ্যমে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের সুপারিশ করে। সে সুপারিশেরও পাঁচ বছর হতে চলল। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চিঠি চালাচালিতেই বছরের পর বছর পার হচ্ছে। সর্বশেষ এ নিয়ে বৈঠক হলেও ফল আসেনি কিছুই। যুবক সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্য সরকার পর পর তিনটি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে। এগুলো হলো-ফরাসউদ্দিন কমিশন, রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে যুবক কমিশন এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি। তিনটি সংস্থাই প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে যুবকের সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকের পাওনা মেটানোর কথা বলেছে। যোগাযোগ করা হলে যুবকের ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন (মুকুল) জনকণ্ঠকে বলেন, দেশব্যাপী মাঠ পর্যায়ে জরিপ করতে আমরা সরেজমিনে তদন্ত করেছি। ভিডিও ফুটেজ নিয়েছি। লোকেশন, ম্যাপসহ সম্পদের চিত্র আমাদের কাছে আছে। সম্পদের যে অনুসন্ধান পেয়েছি, তাতে সম্পদের বর্তমান বাজার মূল্য হবে ছয় থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। আমাদের পাওনা মাত্র আড়াই হাজার কোটি টাকা। সংগঠনটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আজের আলী সরকার বলেন, আমরা সরকারের টাকা চাই না, যুবকের সম্পদ বিক্রি করে পাওনা মেটানো হোক। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, প্রশাসক নিয়োগ দিন। প্রশাসক নিয়োগ দিলে আমরা সম্পত্তি উদ্ধার কিংবা বিক্রির ব্যাপারে সহযোগিতা করব। সহসভাপতি আব্দুল বারেক বারী জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী যুবকের প্রতারকদের বিচার না করে বিচার করলেন অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের। গ্রাহকরা নিঃস্ব পথের ফকির। প্রতারকদের বিচার না করে তাদের অবৈধ কর্মকা- করার সুযোগ করে দিলেন। জানা গেছে, গত ২০১৪ সালের ১৫ জুলাই পুুলিশ বাদী হয়ে যুবকের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করে। যার মামলা নং ২৩/২৬২। পল্টন থানার এসআই আব্দুল্লাহ বিশ্বাস ওই মামলার বর্তমানে তদন্ত অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মামলাটির চার্জশীট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ওই মামলার আসামিদের গ্রেফতারও করা হতে পারে। যুবকে ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু তাহের বলেন, যুবক কমিশনের কোন সুপারিশই বাস্তবায়ন করা হয়নি। নিয়োগ হয়নি প্রশাসক। অথচ যুবকের যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা বিক্রি করলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পাওনা মেটানো সম্ভব।
×