ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আব্দুল্লাহ আল মাছুম

আশাজাগানিয়া

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

আশাজাগানিয়া

মামলা দায়েরের ৪ বছর ৯ মাস ২ সপ্তাহ ৬ দিনের মাথায় অবশেষে রায় পেল তারেক মাসুদের পরিবার। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের সিইও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন। দুর্ঘটনার ১ বছর ৬ মাস পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জে মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১২৮ ধারায় বাসমালিক, চালক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা করেন। পরে পরিবারের দায়ের করা ক্ষতিপূরণ মামলা দুটি হাইকোর্টে বদলির নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করা হয়। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মামলা দুটি বদলির আবেদন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টে মামলা বদলি সংক্রান্ত আবেদন মঞ্জুরেরও ৩ বছর ১ মাস ৪ দিন পর গত ৩ ডিসেম্বর মামলার রায় ঘোষিত হলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরের মতো সর্বজন পরিচিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি মামলার এ দীর্ঘসূত্রতা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কী হবে? সাধারণ মানুষ রাজপথে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকা আর ভাগ্যে জুটলে পত্রিকার পাতায় তাদের সংখ্যা গণনা ছাড়া আর কিছুই হবে না এবং হয়ওনি। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন এমন ঘটনা বিরল। বলতে গেলে সাধারণ মানুষের জন্য এ রায়ের কল্পনাও হাস্যকর। পত্র-পত্রিকায় এ প্রশ্নও উঠেছে, সাধারণ মানুষ মোটরযান দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে, তা জানে না। তাই কেউ মামলা করে না। ক্ষতিপূরণও আদায় হয় না। কিন্তু জেনেও তেমন লাভ নেই। তারেক মাসুদের পরিবারের পক্ষে ড. কামাল হোসেনের মতো আইনজীবীরা আইনি সহায়তা দেয়ার পরও কত দিনের অপেক্ষা। দীর্ঘসূত্রতার প্রসঙ্গে বিরল এ মামলার আরেকটি উদাহরণ না দিলেই নয়। ১৯৮৯ সালে মিনিট্রাকের চাপায় দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু নিহত হওয়ার ২১ বছর পর ২০১০ সালে ২ কোটি ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। দীর্ঘসূত্রতার পরও যদি ক্ষতিপূরণের রায় হয় তবে সব অপেক্ষাই-কষ্টের অবসান হয়। কিন্তু ক্ষতিপূরণের রায় পেয়েছেন এমন উদাহরণ তেমন কই? আমি যদি আগামীকাল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাই তবে আমার পরিবারের পক্ষে কি সম্ভব বছরের পর বছর মামলা চালানো? আমি তো তারেক মাসুদ নই, আমার পরিবারের পক্ষে তো ড. কামাল হোসেনের মতো কেউ এসে দাঁড়াবে না, পত্রিকার পাতায় ব্যানার হবে না, কোন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি খোঁজ নেবেন না। আমি যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হই, তাহলে আমার পরিবারের অসহায় সদস্যের মানবেতর জীবনের খোঁজ কি কেউ নেবে? তবু বলা যায়, দীর্ঘদিন পর এ রকম তাৎপর্যপূর্ণ রায়ে অনেক সচেতন নাগরিকের মনে আশার আলো জ্বলে উঠেছে। এক রকম অলিখিত ধারা ‘সড়ক দুর্ঘটনার বিচার নাই’ অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসছে রাষ্ট্র। বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে দাপুটে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের এ রায় নতুন করে ভাবাবে। এ রায়ে বাস চালক, বাস মালিক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য যে দায়মুক্ত নয়, তা আবারও প্রমাণ হলো। এ এমন নজির দীনমজুর আর প্রভাবশালী উভয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে এটাই প্রত্যাশীত। সবার রক্ত লাল, রক্তের মূল্য সমান। ক্ষতিপূরণ আদায়ের রায়ের এ দৃষ্টান্ত চলমান থাকুক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে
×