ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ, শৃঙ্খলা ও সহানুভূতিশীলতার মাধ্যমে বন্ধন দৃঢ় করুন

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ, শৃঙ্খলা ও সহানুভূতিশীলতার মাধ্যমে বন্ধন দৃঢ় করুন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ, শৃঙ্খলা ও সহানুভূতিশীলতার মাধ্যমে বন্ধন দৃঢ় করার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি বিজিবির সদস্যরা শৃঙ্খলা রক্ষা করে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, বিজিবি’র সদস্য হিসেবে আপনাদের পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, মানবিকতা এবং সর্বোপরি পারস্পরিক সহানুভূতিশীলতাই এই বাহিনীর বন্ধন দৃঢ়তর করবে। কাজেই ভবিষ্যতে সবাই বাহিনীর নিজস্ব শৃঙ্খলার বিষয়টি ভালভাবে জেনে নিয়ে চর্চা করবেন এবং দেশের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করবেন। বুধবার রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে ‘বিজিবি দিবস-২০১৭’ উপলক্ষে আয়োজিত কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ এখানে বিজিবিতে একটি নতুন পরিবেশ; এ পরিবেশ দেখে আমি সত্যিই আনন্দিত। আমি সবসময় এটাই চাই যে, এ বাহিনী নিজস্ব শৃঙ্খলার বিষয়টা ভালভাবে তারা মান্য করবে। দেশের কল্যাণ করে যাবে।’ তিনি বলেন, বিজিবি’র সদস্য হিসেবে আপনাদের আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত। সীমান্ত রক্ষা, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং প্রাকৃতিক কিংবা সামাজিক যে কোন দুর্যোগে বিজিবি জাতির আস্থার ঠিকানা। তিনি বলেন, ‘আপনারা সকলে দেশপ্রেম, সততা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। বিজিবির উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতে সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’ এর আগে প্রধানমন্ত্রী বিজিবি সদর দপ্তরে এলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোঃ মোস্তফা কামাল এবং বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। পরে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী বিজিবি সদর দফতরের বীরউত্তম আনোয়ার হোসেন প্যারেড গ্রাউন্ডে বিজিবি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন এবং সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্যারেড কমান্ডার এবং বিজিবি’র উপ-মহাপরিচালক মোঃ জুলফিকার আলী। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ, তিনবাহিনী প্রধানগণ, বিদেশী কূটনিতিকবৃন্দ এবং পদস্থ সামরিক ও বেসমারিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। কুচকাওয়াজে সালাম নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ‘বীরত্বপূর্ণ ও কৃতিত্বপূর্ণ’ অবদানের জন্য নয় জন বিজিবি সদস্যকে চলতি বছরের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পদক (বিজিবিএম), ১৮ জনকে রাষ্ট্রপতি গার্ড পদক (পিবিজিএম), নয় জনকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সেবা পদক (বিজিবিএমএস) এবং ১৫ জনকে রাষ্ট্রপতি বর্ডার গার্ড সেবা পদক (পিবিজিএমএস) পরিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী পরে বিজিবি সদস্যদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ ডিসপ্লে ‘উৎস থেকে মোহনা’ উপভোগ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বীরোত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে বিজিবি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ দরবারেও বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বিজিবি’র উন্নয়নে সরকারের সব রকম সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়ে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ বিবেচনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ একটি গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান। এই বাহিনী ২শ’ ২২ বছরের ঐতিহ্যম-িত। ১৭৯৫ সালে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন নামে প্রথম গড়ে তোলা হয় এই বাহিনী। সময়ের ব্যবধান ও ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে নানান নামে দায়িত্ব পালনের পর এখন বিজিবি নামে সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসাবে কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধে তখনকার ইপিআরের ভূমিকার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম প্রহরেই এ বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিরোধে নামে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পিলখানা থেকে তৎকালীন ইপিআরের বেতার কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করায় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে সুবেদার মেজর শওকত আলীসহ চারজনের প্রাণদানের কথাও স্মরণ করেন তিনি। তিনি বলেন, ইপিআরের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বাঙালী সৈনিক সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং ৮শ’ ১৭ জন শাহাদতবরণ করেন। এই বাহিনীর দু’জন বীরশেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ আমাদের গর্বের প্রতীক। এছাড়া ইপিআরের ৮ জন বীরউত্তম, ৩২ জন বীরবিক্রম এবং ৭৭ জন বীরপ্রতীক মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করে বিজিবি’র ইতিহাস সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি তাঁদের সবাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। রক্তাক্ত বিডিআর বিদ্রোহের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আমরা সরকার গঠনের ১ মাস ১৯ দিনের মাথায় ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআরে একটা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যায়। যা দ্রুত সমাধান করে আমরা নতুন আইন করি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পুনর্গঠন করি। তৎকালীন বিডিআরের ট্রাজিক ঘটনায় শহীদ ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিরোধ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং জনসাধারণের জানমাল রক্ষায় বিজিবি’র সদস্যদের দায়িত্বশীল ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসরদের পরিকল্পিত টানা অবরোধে গাড়ি ভাংচুর এবং চলন্ত গাড়িতে পেট্রোলবোমায় জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যাসহ দেশ অচল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল। আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তা বানচালে সক্ষম হন। তিনি বলেন, এরকম বহু ঘটনায় বিজিবি সবসময় জনগণের জানমাল রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে এবং এ অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে কাজ করছে। আমাদের অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়, সেখানেও যেমন বিজিবি ভূমিকা রাখে, আবার মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলাতেও বিজিবির বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যা, মায়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা, রামুর বৌদ্ধপল্লীর নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন, পার্বত্য এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, ছিটমহলবাসীকে পুনর্বাসনে আপনাদের পদক্ষেপ বিজিবি’র সুনাম ও মর্যাদাকে বৃদ্ধি করছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যা সমাধানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা সীমান্ত আইন করে গিয়েছিলেন। আমরা ক্ষমতায় আসার পর আলোচনা করে সেই সীমান্ত আইন বাস্তবায়ন করেছি। এক্ষেত্রে ছিটমহলবাসীকে বিজিবি সহায়তা করেছে। ছিটমহল বিনিময়েও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে তারা। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গা সমস্যায় মিয়ানমার সীমান্তে যখন উত্তেজনা হয় বা পার্বত্য এলাকায় যখন কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশ হয়, প্রতিটি সময় বিজিবি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী বিজিবি’র উন্নয়নে তাঁর সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, ভারত এবং মিয়ানমারের মতো সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অংশেও সর্বমোট ৩ হাজার ১৬৭ কিলোমিটার রিং রোড নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। মিয়ানমার সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে বিজিবি’র নতুন রিজিয়ন গঠনসহ অতিরিক্ত ২৫ প্লাটুন জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারপ্রধান বলেন, দ্রুত টহলের লক্ষ্যে প্রতিটি বিওপিতে ৪টি মোটরসাইকেলের প্রাধিকার নির্ধারিত হয়। ১ হাজার ৪ শ’ মোটরসাইকেল সরবরাহ করেছে। এছাড়াও অধিক দূরত্বের বিওপি’র মধ্যবর্তী স্থানে ১২৮টি বর্ডার সেন্ট্রি পোস্ট (বিএসপি) নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় নারী সংক্রান্ত বিষয়ে দেখাশুনা এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বিজিবি’তে নারী সৈনিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
×