ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রীদের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ ।। প্রশ্ন ফাঁসে তালগোল

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭

মন্ত্রীদের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ ।। প্রশ্ন ফাঁসে তালগোল

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে দুই মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দফতর। একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না প্রাথমিকের শিশুদের বার্ষিক পরীক্ষাও। অথচ প্রাথমিক মন্ত্রণালয় যেন দর্শক। কোন বক্তব্য নেই মন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বা অন্য কারো। অন্যদিকে ফাঁস নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের একেক সময় একেক বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। ‘কেবল শিক্ষকদের দায়ী’ কিংবা ‘সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টে প্রশ্ন ফাঁস’ এমন বক্তব্য নিয়ে আপত্তি উঠেছে। এছাড়া দুদক চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য সরকারের বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তাকে দায়ী করা হলেও শিক্ষামন্ত্রী কেবল শিক্ষকদের দায়ী করায়ও বাড়ছে অসন্তোষ। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, সরকারের সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কর্মকর্তা এমনকি বিটিআরসি কেউই অপরাধীর নাগাল পাচ্ছে না, যা উদ্বেগের কারন। সরকারের সাফল্যকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ‘প্রশ্ন ফাঁস’। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যত অন্ধকার। যে কোন পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। প্রশ্ন ফাঁসের ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, যা একটা জাতিকে মেরুদ-হীন করে দেবে। অনেকে হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, ভবিষ্যতে মনে হয় পরীক্ষাই নেয়া যাবে না। শিক্ষাবিদ অনেকেই আজকের এ অবস্থার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের কথা যেমন বলছেন তেমনি বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসে বিচারহীনতাই আজকের এ অবস্থার অন্যতম কারন। কয়েক বছরের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, যে কোন পরীক্ষা হলেই প্রশ্ন ফাঁস একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। আগে বিসিএস পরীক্ষার জন্য এটি নিয়মিত ঘটনা হলেও বর্তমানে সরকারী কর্মকমিশনের নানামুখী উদ্যোগে এখন সবচেয়ে আস্থার স্থল হয়েছে পিএসসির পরীক্ষা। তবে দিন যত যাচ্ছে অন্যান্য স্তরে বাড়ছে সঙ্কট। প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে সকল পাবলিক পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা কিছুই বাদ যাচ্ছে না। তবে সব সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের অস্বীকারের প্রবণতা কোন পরীক্ষাকেই সুষ্ঠু করতে পারছে না। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা। চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরক্তও তারা। বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস যেহেতু ঠেকানো যাচ্ছে না, তাহলে এত আয়োজন করে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে কেন? দেখা যাচ্ছে অভিভাবকদের অভিযোগের সত্যতাও আছে। প্রশ্ন ফাঁস রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও দফতরের অবস্থা লেজেগোবরে। বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বাস্তবতা বারবার অস্বীকার করায় পুরো বিষয়টি এখন সরকারের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। সর্বশেষ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তারপরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রকৃত উৎসমূল বের করা যাচ্ছে না। মূল হোতারা তাই এখনও রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসেব মতে, চলতি বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ৭১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৩৬ জন গ্রেফতার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় দুর্নীতি করতে গিয়ে। অন্যরা পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন। ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রসহ আরও আটজনকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এ বিষয়ে এখন তৎপর। প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে দুদক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একগুচ্ছ সুপারিশ পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে কোচিং ও নোট-গাইড বই বন্ধ করাসহ কয়েকটি বিষয়ে মোট ৩৯টি সুপারিশ করেছে কমিশন। সংস্থাটি বলেছে, শিক্ষা বোর্ড, বিজি প্রেস, ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্র হলো প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য উৎস। ওই সব প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণীর কর্মকর্তার সঙ্গে কোচিং সেন্টার, ‘প্রতারক শিক্ষক’ ও বিভিন্ন অপরাধী চক্র মিলে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে দুদক। দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থটির মূল্যায়ন হলো পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস দুর্নীতির নতুন সংযোজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস আগেও ছিল। ও রোগ পুরনো। তবে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে প্রশ্ন ফাঁস। অনেক ক্ষেত্রে টাকা আবার অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতেই ফেসবুকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে প্রশ্ন। ১৯৭৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে এ দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা বাড়ছে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপর বিভিন্ন সময় একটি-দুটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র কখনও কখনও ফাঁস হলেও কয়েক বছর ধরে পরীক্ষা হলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে বা অভিযোগ উঠছে। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার গণিত বিষয়ের প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগেই ফাঁস হলেও পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি। সর্বশেষ গত মাসে অনুষ্ঠিত জেএসসি এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু বিষয়টিকে আমলেই নেয়নি শিক্ষা বোর্ড। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষারও একই অবস্থা। তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও অভিযোগ ওঠে। ঠিক এমনই এক অবস্থায় রবিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় প্রশ্ন ফাঁসের জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনই দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন দুককের ভাবপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য শিক্ষা বোর্ড, সরকারী বিজি প্রেস, ট্রেজারি এবং পরীক্ষা কেন্দ্রের অসাধু কর্মকর্তারাই দায়ী। সারাদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পরীক্ষায় যত জায়গায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জড়িত। আমরা কিছু শনাক্তও করেছি। আমাদের শক্ত অস্ত্র আছে। কিন্তু আমরা তো সেই কাজে আসিনি। আমরা চাই, এ দেশের বিশেষ করে ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে; পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষা যেন হয়। তবে ওই অনুষ্ঠানেই শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী করেছেন কেবল শিক্ষকদেরই। তিনি বলেছেন, কিছু শিক্ষই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে শিক্ষকরা জড়িত থাকার কারণে নানা পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না। ওই অনুষ্ঠানের বুয়েটের প্রসঙ্গ টেনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বুয়েটে কেবল একটি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয় তার পরও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। তবে পরদিন সোমবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের এক অনুষ্ঠানে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করলেও এর মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করাই লক্ষ্য বলে দাবি করেন শিক্ষামন্ত্রী। সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে একশ্রেণীর শিক্ষক প্রশ্ন ফাঁস করছেন বলে মনে করেন তিনি। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে দুদিন ধরে সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিতরণের সঙ্গে শিক্ষকের অংশগ্রহণ ১০ ভাগের বেশি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্রেজারিতে থাকে প্রশ্ন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থাকে সবচেয়ে বেশি। এমনকি বিজি প্রেস থেকেও প্রশ্ন যারা নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে যান তারাও শিক্ষক নন। তার পরও কেবল শিক্ষকদের দায়ী করা কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষকের অনেকেই। তাছাড়া প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা না গেলে কোন কথা শুনতে রাজি নন অভিভাবকরাও। বুয়েটের শিক্ষকরা বলছেন, বুয়েটে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। তাহলে কেন বুয়েটকে এখানে যুক্ত করা হলো? বুয়েটের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা দুদিন ধরেই সমালোচনায় সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারা বলছেন, বুয়েটকে অযথাই এখানে টানা হয়েছে; যা অযৌক্তিক। শিশুদের অভ্যন্তীণ এ পরীক্ষার অব্যাহত প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার পরও নীরব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বার্ষিক পরীক্ষার এ প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রালয় বা সংশ্লিষ্ট অধিদফতর আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি। দফায় দফায় প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁস হলেও মন্ত্রী বা সচিব বা কারো কোন অবস্থান জানতে পারছেন না কেই। তবে গণমাধ্যমে এসব প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা নিয়ে একটা জবাব দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেন। কমিটির সভা শেষে তিনি বলছেন, প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণীর পরীক্ষার প্রশ্ন সরকার করে না। এসব পরীক্ষার প্রশ্ন হয় উপজেলা পর্যায়ে। তাই এসব পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের দায় সরকারের নয়। তিনি বলেন, কীভাবে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, তা তারা জানেন না। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে কমিটি। এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষকরাই দায়ী- শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ কমিটির নেতৃবৃন্দ। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে এমন দাবি জানায় লিয়াজোঁ কমিটি। বিবৃতিতে বলা হয়, পাবলিক পরীক্ষাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস রীতিমতো আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমরা সম্মিলিতভাবে যদি এর মূলোৎপাটন করতে না পারি তাহলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। বরাবরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত যে বা যারাই থাকুক না কেন তাদের খঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি করে আসছে শিক্ষক সমাজ। সেখানে খোদ শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নপত্রের সঙ্গে কারা কারা যুক্ত থাকেন তাদের মধ্যে কে বা কারা প্রশ্ন ফাঁস করেন তাদের খুঁজে বের করার জন্য দুদকের কাছে সহযোগিতা না চেয়ে এককভাবে দেশের গোটা শিক্ষক সমাজকে দুষলেন। শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যের কারণ কি তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। শাস্তিহীনতাই প্রশ্ন ফাঁসের বড় কারণ ॥ ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকলে শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ অর্থদ-।’ পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে এই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আইন প্রণয়নের পর পাবলিক, মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় শতাধিকবার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও এক মাস শাস্তিরও নজির নেই কোন অপরাধীর। কেলেঙ্কারির পর পরীক্ষা স্থগিত করে অন্তত অর্ধশতবার তদন্ত কমিটি গঠন করে সঙ্কট সমাধানের সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি একটি সুপারিশও। ফলে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগাতার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ম্লান হতে বসেছে সরকারের অনেক অর্জন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যত অন্ধকার। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, শিক্ষাটা কেনাবেচার ব্যাপার হয়ে গেছে। এখন টাকা দিলেই প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়, ফল ভাল করা যায়। এর সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাপার জড়িত। শ্রেণীকক্ষের লেখাপড়ার চেয়ে পরীক্ষার ফলের ওপর গুরুত্ব দেয়ায় এমনটি হচ্ছে। জবাবদিহি না থাকায় প্রশ্নপত্র ফাঁস থামছে না-এমন মত দিয়ে তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম উপায় হলো অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা। সরকার, মন্ত্রণালয় এবং পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দায়িত্ব নিতে হবে। সর্বোপরি ফলনির্ভর শিক্ষা থেকে বের হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। পরীক্ষার ভার কমানোর তাগিদ দিয়ে এ শিক্ষাবিদ বলেন, পরীক্ষার ভার কমানো হলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা এমনিতেই কমে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, যে কোন পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আজ যেসব শিক্ষার্থী ভাল রেজাল্ট করল তাদের মন ভার কেন? কারণ অনেকেই তাদের টিপ্পনী কেটে বলবে, তোমরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ভাল ফল করেছ! জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ ইকরামূল কবীর বলছিলেন, আসলে শিশুদের পরীক্ষা নিয়েও এখন একটি মহল ভুয়া প্রশ্ন ছেড়ে দিয়ে বাণিজ্য করে। তার পরেও বিভিন্ন সময় কিছু পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় মানুষ আস্থা হারিয়েছে। তিনি বলেন, এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে আস্থা হারিয়েছে বলে সকল পরীক্ষা নিয়েই গুজবে কান দেয়া ঠিক নয়। আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুরো প্রক্রিয়াকে মানুষের কাছে আরও স্বচ্ছ করতে হবে। একটি জাতীয় কমিটি করা যেতে পারে। যে কমিটি করলে মানুষ আরও আস্থা পাবে। তবে এই কমিটি কোন প্রশ্ন দেখতে পারবে না। তারা পরীক্ষা মনিটরিং করবে। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বেশি জরুরী বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে চায়। অথচ শিক্ষানীতিতে না থাকা প্রাথমিক ও জেএসসি নামের দুটি পরীক্ষা চালু রেখেছে। এর অর্থ পরীক্ষার জন্য সিন্ডিকেটের চাপ রয়েছে। তিনি বলেন, দেশে কোচিং বাণিজ্যের আকার এখন প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। কোচিং ব্যবসা যারা করে তারাই প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত। এ ছাড়া সরকারের কিছু লোকও এর সঙ্গে জড়িত বলে দুদকই জানিয়েছে। এই কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করলেই প্রশ্ন ফাঁসও অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর এ জন্য সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিশুদের জন্য পাবলিক পরীক্ষার কি প্রয়োজন? তা তুলে দিতে হবে। এটা আত্মবিশ্বাস জাগানোর বদলে কোচিং বাণিজ্য বাড়াচ্ছে।
×