ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুকুমার বিশ্বাস

মুক্তিযুদ্ধ এবং তার প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধ এবং তার প্রেক্ষাপট

(গতকালের পর) আমাদের শরণার্থী হয়ে ভারতে যাবার পথের খরচ এবং কিছু টাকা প্রয়োজনে রাখার জন্য আমার বাবাকে অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করতে হল। আমাদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। বাবা তখনকার ই,পি,আর,এস অর্থাৎ ষ্টীমার চলাচল সংস্থার ঠিকাদার ছিলেন এবং শ্রীরামকাঠী ষ্টেশনের টিকিট মাষ্টারের বাসস্থান এবং গুদাম থেকে একটি বড় অংকের ভাড়া পেতেন। চাকাওয়ালা বড় বড় ষ্টীমার চলাচল করত বরিশাল হয়ে খুলনা শহর পর্যন্ত। মাঝ নদীতে ষ্টীমার নোঙ্গর করলে তীর থেকে যাত্রীদের বড় নৌকা করে ষ্টীমারে পৌছে দিত এবং যে যাত্রীরা তীরে আসবেন তাদের তীরে নামিয়ে দিত। শ্রীরামকাঠী বন্দর এবং পাটগাতী বন্দরের ষ্টীমার ঘাটের দু’শ যাত্রী ধারণক্ষমতার নৌকা দুটি আমার বাবা ঠিকাদার হিসেবে পরিচালনা করতেন। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা আমাদের আয়ের উৎস নৌকা দুটি মুক্তি সংগ্রামের সময় কুড়াল দিয়ে ছিদ্র করে কালীগঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে দিল। স্টেশনমাস্টারের বাসভবন এবং গুদামের ক্ষতিসাধন করল। তাই আমরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়লাম। আমার বাবা নামকরা হাডুডু খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি আমাদের দেশে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খেলায় অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করেছিলেন। আজ আমাদের বাবা-মা বেঁচে নেই কিন্তু তাদের শুভাশীর্বাদ আমাদের সঙ্গে সর্বদা রয়েছে। আমাদের শরণার্থী হয়ে যাবার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। আমরা বাবা-মাকে প্রণাম জানিয়ে তাঁদের আশীর্বাদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। পরম পূজনীয় বাবা-মা আমাদের ছলছল চোখে বিদায় দিলেন। আমার মা যাত্রা পথে খাবার জন্য চিড়া, মুড়ি এবং কিছু গুড় সঙ্গে দিলেন। মুক্তি সংগ্রামের সময় সদরপথে যাতায়াত করা সম্ভব ছিল না কারণ যে কোন সময় পাক মেলেটারী এবং রাজাকার বাহিনীর আক্রমণের শিকারে পরিণত হতে পারি আমরা। তাই আমাদের গোপন পথে সতর্ক হয়ে ভারতে রওনা হতে হলো। বাংলায় এ সময় বড় বড় নৌকা ছিল। এ নৌকাগুলোতে পাল তুলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য পরিবহন করে নেয়া হতো। এসব নৌকায় দু’তিনশত মানুষ অনায়াসে যাতায়াত করতে পারত। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের বাহন ছিল এ নৌকাগুলো। আমাদের এ অঞ্চলের শরণার্থীরা চৌমোহনী, পয়সারহাট, কোটালীপাড়া, কদমবাড়ীর বিশাল বিল পার হয়ে মুক্তাঞ্চলের ভিতর দিয়ে যশোর সীমান্তে পৌঁছে যেত। পথে লুটেরার দল বা রাজাকার বাহিনী যাতে কোন সমস্যা সৃষ্টি না করতে পারে এজন্য মুক্তিযোদ্ধারা ছিপ নৌকায় টহল চৌকি বসিয়েছিল। আমরা একটি বড় নৌকায় পয়সারহাট হয়ে ভারতে যাত্রা শুরু করলাম। আমরা ছিলাম নৌকার দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী অর্থাৎ আমরা ছিলাম গুড়ার উপরে কাঠের পাটাতনের যাত্রী। আমাদের মাথার উপরে যে পাটাতন সেখানের যাত্রীদের ভাড়া অপেক্ষাকৃত বেশি। আমাদের পাথেয় কম থাকায় আমরা নিচের পাটাতনের যাত্রী হয়েছিলাম। ধু-ধু বিলগুলো ভরা শ্রাবণে মনে হচ্ছিল একটা বিশাল সমুদ্র। বাতাসে মৃদু মৃদু ঢেউয়ে দুলতে দুলতে পালতোলা নৌকাটি এগিয়ে চলছিল। এভাবে আমরা সন্ধ্যা নাগাদ লোহাগড়া-লক্ষ্মীপাশা পৌঁছে গেলাম। সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে দেখা হলো। এ অঞ্চলটি সে সময় মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আমাদের শরণার্থীদের স্কুল ঘরে এবং কোন কোন বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। কিছু চাল এবং আলু কিনে ইট দিয়ে চুলা তৈরি করে আলু সিদ্ধ ভাত তৈরি করা হলো। রাতে সবাই খেয়ে স্কুলের বেঞ্চের উপর ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে হাত-মুখ ধুয়ে পান্তাভাত খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। হাজার হাজার নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো বৃষ্টিভেজা কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলছে তো চলছে। এ যেন মহা প্রস্থানের পথে যাত্রা। পথ চলতে চলতে দেখলাম পঙ্গু পিতা-মাতাকে ঝুড়িতে বসিয়ে বাঁশের দোলা তৈরি করে যুবক ছেলেরা কাঁধে বয়ে নিয়ে চলছে। আমাদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তা অবর্ণনীয়। স¦াধীনতার এত বছর পর আমরা আর এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না বা পুনরাবৃত্তি হতে দেয়া যাবে না। পথের ক্লান্তি আছে তবু চলতে হবে, গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। চলতে চলতে দেখলাম বিশাল এক বটবৃক্ষ। কয়েক বিঘা জমি নিয়ে ছড়িয়ে আছে বৃক্ষটি। অনেক যাত্রীকে দেখলাম ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লান্তি দূর করবার জন্য। আমার তখন মনে হলো ভারতমাতা স্নেহের বাহু তুলে আমাদের কোলে তুলে নিতে প্রস্তুত হয়ে আছেন। এভাবে আমরা দলে দলে লাখ লাখ শরণার্থীরা পথের বাধা অতিক্রম করে সীমান্ত পার হয়ে ভারতমাতা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আঁচল তলে ঠাঁই পেলাম। সীমান্তের ওপরে দেখলাম শরণার্থীদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নানা আয়োজন। আমাদের লাইন করে দাঁড়ানোর জন্য বলা হলো। শরণার্থীদের প্রত্যেককে রোগ প্রতিষেধক টিকা দেয়া হলো। আমরা ক্ষুধায় অনেকে কাতর হয়ে পড়েছি তাই শুকনো খাবার পরিবেশন করা হলো। প্রত্যেকের হাতে দেয়া হলো একটি লিখিত কাগজ যার নাম বর্ডার স্লিপ। এ কাগজটি দেখিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পাওয়া যাবে এবং নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা যাবে। আমার বাবা, মা, ছোট ভাই সর্বকনিষ্ঠ বোনটি সংগ্রামী জনতার সঙ্গে মিলে মিশে কষ্ট স¦ীকার করে এদেশেই রয়ে গেলেন। জুন মাসের শেষের দিকে আমার জন্ম ভিটা শ্রীরামকাঠী গ্রামে তাদের পক্ষে আর থাকা সম্ভব হলো না। চুরি, সাজানো, ডাকাতি, রাজাকারদের অত্যাচারে গ্রাম, বন্দর বিরান ভূমিতে পরিণত হলো। থেকে থেকে দূরে গুলির শব্দ আর অভুক্ত কুকুরের আর্ত চিৎকার। একদিন সবাইকে নিয়ে আমার প্রিয় বাবা চুপি চুপি স¦রূপকাঠীর পেয়ারা বাগান সংলগ্ন ব্রাহ্মণকাঠী গ্রামে চলে গেলেন। তাদের একমাত্র বাহন সেই কুড়িয়ে পাওয়া নৌকাখানি। ব্রাহ্মণকাঠী গ্রামে আমাদের একটি বাড়ি আছে। শত শত একর জমিতে পেয়ারা বাগান। মাইলের পর মাইল পেয়ারা জঙ্গল, মুক্তিবাহিনী গভীর বাগানে ক্যা¤প করেছে। পাকবাহিনী, রাজাকার বাহিনী এবং দালালদের ওপর আক্রমণ এই বাগান থেকে পরিচালনা করা হতো। কিন্তু পাকসেনা বা রাজাকার বাহিনী পেয়ারা বাগান সংলগ্ন গ্রামগুলোতে আসার দুঃসাহস কখনও করেনি। ফলে মোটামুটি নিরাপদে থেকেছেন সবাই। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খবরাখবর সরবরাহ করে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন আমার বাবা। দু’মাস এভাবে পেয়ারা বাগান সংলগ্ন গ্রাম ব্রাহ্মণকাঠীতে থাকার পর একদিন সেই নৌকা চড়ে চৌমোহনী, পয়সারহাট, কোটালীপাড়া হয়ে বিশাল বিল পাড়ি দিয়ে সাতপাড় আমার বড় দিদির বাড়িতে বাবা সবাইকে নিয়ে পৌঁছলেন। এই মুক্তাঞ্চলে আমার বাবা দেশ স¦াধীন না হওয়া পর্যন্ত দিদির বাড়িতে থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশ বাণী কলকাতা এবং বিবিসি কেন্দ্রের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির খবর শুনে সময় কাটিয়েছেন। কখনও কখনও বিলে মাছ ধরে সময় পার করেছেন। আমরা কিন্তু ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করিনি। আমার মেঝ ভগ্নিপতির সহপাঠী বন্ধু এদেশ ত্যাগ করে বহু আগে পশ্চিমবঙ্গের সোদপুর শহরে বসবাস করছেন। তিনি আমাদের পঞ্চাশ রুপী ভাড়ায় একটি বাসস্থানের ব্যবস্থা করলেন। কলকাতায় একটি কো¤পানিতে একশত সত্তর রুপী বেতনে চাকরির ব্যবস্থা করলেন আমার মেঝ ভগ্নিপতির জন্য। কোনরকম করে বাঁচার একটা ব্যবস্থা হলো। আমি একদিন সোদপুর রেলস্টেশনে বেঞ্চের ওপর বসে রেলগাড়ী এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষজন দেখছিলাম। হঠাৎ আমার গ্রামের পাশের গ্রামের হরষিত দাদার সঙ্গে দেখা হলো। তার মাথায় একটি মুড়ির বস্তা। তিনি বললেন বারাসাত থেকে পাইকারি মুড়ি এনে পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করে কিছু টাকা রোজগার করেন। আমি দাদাকে অনুরোধ করে বললাম আমিও এ ব্যবসা করব। দাদা বললেন রোদে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে হবে, বেশ কষ্ট হবে। আমি বিশেষভাবে হরষিত দাদাকে বলায় আমাকে তিনি তার সঙ্গী করলেন। বেশ কিছুদিন দাদার সঙ্গে মুড়ি ফেরি করে রোজ আট দশ রুপী পেতাম কিন্তু রোদে ঘুরতে ঘুরতে আমি অসুস্থ হলাম। আমার পক্ষে সম্ভব হলো না আর এ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া। দাদার কাছে ক্ষমা চেয়ে মুড়ি ফেরি করা থেকে বিদায় নিলাম। এরপর একটি ভুষি মালের দোকানে চাকরি পেলাম। বেতন পঞ্চাশ রুপী। সপ্তাহে একদিন ছুটি। এটি একটি গরু-মহীষের খাবার বিক্রির দোকান। বিভিন্ন প্রকারের ভুষিমাল, ভেলিগুড় আমাকে দাড়িপাল্লায় মেপে ক্রেতাকে সরবরাহ করতে হতো। শরীর, জামা-কাপড় অপরিষ্কার হতো। বাসায় এসে স্নান করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে কোন কাজে বাইরে যেতে হত। রবিবার ছুটির দিনে বেরিয়ে থিয়েটার রোড, লবণহ্রদ শরণার্থী শিবির এবং রেলস্টেশনে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করতাম। নতুন কিছু জানার ইচ্ছা, কিছু সৃষ্টির ইচ্ছা আমার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল ছেলেবেলা থেকে। এ শক্তি সাহসের জন্য জীবন যুদ্ধে আমি কখনও হার মানতে চাইনি। (সমাপ্ত) লেখক : গবেষক
×