ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শেখ ফজলুল করিম সেলিম

মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭

মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা

ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উজ্জীবিত সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ছাত্রনেতারা ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে রেসকোর্স ময়দানে যোগ দিয়েছিল। ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন পাক আর্মি তাঁকে আটক করে অমানবিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময় প্রাণে বাঁচতে তিনি পাগলের অভিনয় করে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় পালিয়ে যান। পরে বিএলএফের মিডল ও সাউথ কলামের কমান্ডার হন তিনি। পাহাড়ী এলাকায় তিন শ’ জনেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত একটি দলের নেতা হয়ে সম্মুখ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। বিজয় অর্জনের পর ১৮ ডিসেম্বর বীরের বেশে চট্টগ্রামে ফেরেন বীর চট্টলার এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। পাকসেনাদের অমানবিক নির্যাতনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পিঠের একটি অংশ লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়, যা আর কখনোই ভাল হয়নি। এসব ক্ষত নিয়েই বাকি জীবন পার করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন নির্মোহ। তেমন কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না তাঁর। তিনি সব সময়ই জনগণকে দিতে চাইতেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে শ্রমিক রাজনীতি করা এই মানুষটির সব জায়গায়ই ছিল সফল পদচারণা। তাঁর চট্টগ্রামের বাসা ছিল নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থল। নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের অবাধ বিচরণ ছিল সেখানে। তিনি সবার সঙ্গে দেখা করতেন, কথা বলতেন। সাধ্যমতো সহায়তা করতেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর অন্য নেতাদের মতো মহিউদ্দিন চৌধুরীকেও গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনের প্রতিশোধ নিতে মৌলবী সৈয়দের নেতৃত্বে ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করেন তিনি। পরবর্তীতে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হয় তাঁকে। এক পর্যায়ে কলকাতায় চলে যান তিনি। পলাতক জীবনে কলকাতায় অনেক কষ্টে দিন কেটেছে তাঁর। সে সময় কলকাতায় চায়ের দোকানে কাজ নেন। রেলস্টেশনে পত্রিকা বিক্রি করেন। কর্মীদের খরচ চালানোর জন্য মাটি কেটে পয়সা উপার্জন করতেন। সেই সময় আমিও কলকাতায় ছিলাম। তাঁর সংগ্রামী জীবনযাপন নিজের চোখেই দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর সময় চট্টগ্রামের অন্তপ্রাণ যেসব নেতা ছিলেন তাঁদের মধ্যে জহুর আহমেদ চৌধুরী, আজিজ সাহেব, হান্নান সাহেবরা অন্যতম। আমার দৃষ্টিতে নেতৃত্বগুণ ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে তাঁদের মাপেরই নেতা ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁকে কর্মীদের সঙ্গে কখনোই ছলনা করতে দেখিনি। শারীরিক অসুস্থতার জন্য কখনও কর্মীরা দেখা না পেলেও তাঁর হৃদয়জুড়েই থাকত নেতা-কর্মী আর চট্টগ্রামের মানুষ। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া, স্বৈরাচার পতন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ দেশের যে কোন আন্দোলনে তিনি সব সময়ই সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তিনবারের মেয়র হিসেবে টানা ষোলো বছর দায়িত্ব পালনকালে চট্টগ্রামের চেহারাটাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছিল বন্দরনগরীর প্রতিটি ক্ষেত্রে। নগরীর পরিছন্নতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে উন্নয়ন করেছেন চট্টগ্রামবাসীকে তা স্বীকার করতেই হবে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও তিনি লঙ্গরখানা খুলে বিপন্ন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করে নজির সৃষ্টি করেছিলেন। মৃত মানুষকে নিজ হাতে উদ্ধার করে কবর দিয়েছেন। এসব কর্মকা-ের ফলেই মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামবাসীর নয়নের মণি। ২০০৫ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে আমি আর বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী তাঁকে চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেই। সেই থেকে আমৃত্যু সফলতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সময় তাঁর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। মনে পড়ে, সম্ভবত ১৯৮৬ সালের ১৯ অক্টোবর তাঁকে মেরে ফেলার জন্য বাইরে থেকে তাঁর বাসায় বোমা ছুড়ে মারা হয়। এতে তাঁর স্ত্রী শাহেদা মহিউদ্দিন ও গৃহকর্মী বানু মারা যায়। তবুও দমে যাননি তিনি। ওয়ান ইলেভেনের সময় তাঁর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছিল। তিনি তখন বিদেশে ছিলেন। তা উপক্ষো করে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং গ্রেফতার হন। তাঁর কোন ভয় ছিল না। দলের জন্য যা প্রয়োজন তা করতে পিছপা হতেন না মহিউদ্দিন চৌধুরী। ওয়ান ইলেভেনে আমরা দু’জনই বন্দী হওয়ার পর কারাগারে পাশাপাশি রুমে ছিলাম। বারোটি রুম নিয়ে আমাদের সেল ছিল। আমার পাশের রুমটাতে ছিলেন জনকণ্ঠের সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। তার পরের রুমটাতেই ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। দেখতাম প্রায়ই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। একদিন মধ্যরাতে কারারক্ষী আমার রুমের সামনে এসে বলল, স্যার মহিউদ্দিন স্যার কেমন যেন করছেন। আমি তাঁকে জেলার কিংবা ডেপুটি জেলার যেই থাকুক ডেকে আনার কথা বলি। ডেপুটি জেলার আসার পর আমার রুমের দরজা খুলে দিলেন। আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে মহিউদ্দিন চৌধুরীর রুমের সামনে গেলাম। তখন ডেপুটি জেলার বলল, স্যার আমি কী করব? আমি তাঁর শারীরিক অবস্থা দেখে বললাম, উনাকে এখানে আর রাইখেন না। দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। জেলখানার হাসপাতালে তাঁর ভাল চিকিৎসা হবে না। কারণ তাঁর হার্ট আর কিডনিসহ শারীরিক নানা সমস্যা। তাঁকে ভাল চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। পরে ওই রাতে তাঁরা মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সুস্থ হলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি বিশাল কাফেলা নিয়ে মক্কায় যেতেন হজ করতে। ২০১৫ সালে হজের সময় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। সে সময় দেখলাম অসুস্থতার কারণে তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। কিন্তু এ নিয়ে তিনি মোটেও বিচলিত নন। সঙ্গীরা যাতে কোন ঝামেলা ছাড়াই হজ পালন করতে পারে সেদিকেই তাঁর যত খেয়াল। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত জনগণের সেবায় কাজ করেছেন। এই ব্রত নিয়েই তিনি সারাজীবন রাজনীতি করেছেন। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিহত পরিবারবর্গের সদস্যদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করতেন। অনেক গরু“ও খাসি জবাই করে গরিব মানুষকে খাওয়াতেন। এ বছর ১৫ আগস্টেও তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম থেকে গরু আর খাসি নিয়ে দুদিন আগেই টুঙ্গিপাড়ায় এসেছিলেন। সেগুলো জবাই করে গরিবদের খাইয়েছেন। রাজনীতির বাইরেও মহিউদ্দিন চৌধুরী আমাদের পরিবারের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। আমার বড় ভাই যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণির পছন্দের কর্মী ছিলেন তিনি। আমরা এক সঙ্গেই ছাত্রলীগ করেছি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি একজন পরীক্ষিত ও আদর্শিক কর্মী ছিলেন। যে দায়িত্বই তাঁকে দেয়া হোক না কেন তা সুচারুভাবে পালন করতেন। এই গুণের জন্যই মণি ভাই তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। স্নেহ করতেন। একজন আদর্শিক জননেতা বলতে যা বোঝায় মহিউদ্দিন ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক। মাটি ও মানুষের নেতা। এই মানুষটিকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ একজন মহান নেতাকে হারাল। দেশ হারাল একজন মহৎ ও ত্যাগী মানুষকে। রাজনীতিতে এমন সৈনিক পাওয়া খুব কঠিন। তাঁকে হারানো চট্টগ্রামবাসীর জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। দলের যে কোন বিপদ-আপদে তিনি ভরসা হয়ে সব সময়ই পাশে থাকতেন। এমন নেতার মৃত্যুতে চট্টগ্রামবাসী নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়বে। তাঁর মৃত্যুর পর চট্টগ্রামবাসীর যে আর্তনাদ দেখেছি তা অনেক বড় নেতার ক্ষেত্রেও ঘটেনি। তাঁর জানাজায় দল-মত নির্বিশেষে সবার উপস্থিতিই প্রমাণ করে তিনি কতটা জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ তাঁর পরিবারকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দান করুন। একদিন সবারই চলে যেতে হবে। তিনি যেসব জনহিত কাজ করেছেন তার জন্য আল্লাহ যেন তাঁকে পরজীবনে বেহেশ্ত নসিব করেন। লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, আওয়ামী লীগ (অনুলিখন : পার্থ রহমান)
×