ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রিপোর্টারের ডায়রি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭

রিপোর্টারের ডায়রি

চিত্র বিচিত্র রাজধানীর কোথাও না কোথাও বের হলেই প্রতিদিন কোন না কোন বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। এই ধরুন ‘মামা’ ডাক শোনা। আপনি কারও মামা নন। অথচ অনেকেই আপনাকে মামা বলে সম্বোধন করছে। প্রতিদিন মামা ডাক শোনেন না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইদানীং ঢাকাসহ দেশে বেশিরভাগ এলাকায় সবচেয়ে ব্যবহৃত শব্দের নাম মামা। কথায় কথায় একজন অন্যজনকে এখন মামা বলতে বেশি পছন্দ করেন। সম্পর্কের দিকে বিবেচনা করলে মামা শব্দটিও প্রিয় একটি শব্দ। মায়ের ভাই হিসেবে মামা শব্দটির ব্যবহার। অথচ শব্দটির অপব্যবহার এমন পর্যায়ে গেছে কোন অপরিচিত কাউকেই এখন সবাই মামা হিসেবে সম্বোধন করে থাকে। বিশেষ করে বাসে উঠলেই মামা শব্দটির বেশি প্রয়োগ দেখা যায়। বাসের সুপারভাইজার যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের সময় বলে থাকে ‘মামা ভাড়া’ দেন। বিশ্ব বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই শব্দের অপপ্রয়োগ দেখা যায় হরহামেশায়। সম্প্রতি অফিসে আসছি। মিরপুর থেকে গুলিস্তানগামী বাসে উঠেছি। টেকনিক্যাল মোড় পার হতেই ভাড়া আদায় শুরু হলো। সুপারভাইজার সবার কাছে গিয়ে বলছে ‘মামা’ ভাড়াটা দেন। অথচ যার কাছ থেকে তিনি মামা বলে ভাড়া আদায় করছেন সম্পর্কের দিক দিয়ে তিনি সত্যিকারের কোন মামা নন। তবুও মামা বলেই সম্বোধন করছেন। এর অপব্যবহার এমন পর্যায়ে গেছে যে তিনি শেষ এক যাত্রীর বাছ থেকে ভাড়া চাওয়ার সময় তালগোল পাকিয়ে ফেললেন। উল্লেখ, করলেন ‘মামা ভাড়াটা দেন তো ভাই।’ মামার মধ্যে আবার ভাইও চালিয়ে দিলেন। শুধু মামা বিড়ম্বনা নয়, ঢাক শহরে চলতে হলে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। ওই বাসেই আসার সময় উঠলেন একজন হকার। যাত্রীদের উদ্দেশে তার এখন লেকচার দেয়ার পালা। তিনি লেকচার দিয়ে চলেছেন যে তার মানিব্যাগ খাঁটি চামড়ার তৈরি। বাইরের যে কোন দোকান থেকে কিনতে গেলে দু’শ’ টাকা দাম নেবেই। কিন্তু আমি দু’শ’ টাকা নিচ্ছি না। মাত্র এক শ’ টাকায় একটি চামড়ার মানিব্যাগ আপনাদের দিচ্ছি। এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। অথচ চামড়ার মানিব্যাগ যারা ব্যবহার করেন তারা অবশ্যই জানেন একশ’ টাকায় কখনও মানিব্যাগ পাওয়া যায় না। তিনি সুযোগ বুঝে কাজে লাগালেন। কিছু বিক্রি করে হাসি মুখেই নেমে গেলেন। মানিব্যাগ বিক্রেতা নেমে যাওয়ার পর এবার উঠলেন আর একজন হকার। তিনি নিয়ে এলেন বাচ্চা ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ। তিনটি পেন্সিল একসঙ্গে কিনতে মাত্র ১০টায় কিনতে পারবেন। বাইরে ১০ টাকায় পেন্সিল পাওয়া যায় না। দু’একজন নেড়েচেড়ে দেখলেন। ফলে ওই হকারকে না বেচেই নেমে যেতে হলো। নেমে যাওয়ার সময় মুখটা ভার মনে হলো। বাসটি আরও একটু আগাতেই এবার বাসে উঠলেন দু’জন হিজরা। মুখে হ্যাভি করে মেকাপ মারা। তারা যখন বাসে উঠেন জোড়ায় জোড়ায় ওঠেন। উঠে একেবারে চলে গেলে বাসের পেছনের দিকে। দু’জন দুলাইনে দাঁড়িয়ে এবার বলতে শুরু করলেন ‘এই দাও। মানে টাকা দাও।’ কেউ না দিলেই বা বেখেয়ালে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেই ডেকে বলেন, এই ভাইয়া দাও। না দিলে বা তাদের উদ্দেশে কিছু বলছে প্রথমে দু’হাত জোরে তালি বাজানো হয়। এরপর তাদের মুখ থেকে অম্লমধুর অনেক কথাই হজম করতে হয়। ফার্মগেট খামারবাড়ি সড়কে আসতেই যাত্রীদের পড়তে হয় আর এক বিড়ম্বনার মধ্যে। জোড়ায় জোড়ায় ভিক্ষুক হকার সবাই যে যার মতো আসেন তাদের বিক্রিত পণ্য নিয়ে বা ভিক্ষা চাইতে। এবার আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে। সকাল বেলায় বিছায়নায় শুয়ে আছি। অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমরা আয়েশে এপিট-ওপিট করছি। বেলাও হয়েছে বেশখানেক। মহল্লাও সরগরম। কেউ অফিসে যাচ্ছে। কেউবা আবার বাজারের। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। অত সকালে কোন ব্যস্ততা নেই আমার। হঠাৎ ‘মুরগির’ ডাক কানে এলো। মুরগির ডাক মানে কোন মোরগ বা মুরগি ডাকছে না। মুরগিরে কেউ নাম ধরে ডাকছে। মনে কৌতূহল সৃষ্টি হলো। মহল্লায় ‘মুরগি’ নামে কেউ থাকে নাকি? লোকটা মুরগির নাম ধরেই বা ডাকছে কেন। অগত্যা উঠতে হলো। বারান্দায় এসে দেখি একজন ব্যক্তি ফেরি করে মুরগি বিক্রি করছে। হাতে উল্টা করে ধরা অনেক মোরগ বা মুরগি। মহল্লাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই সে উচ্চারণ করছে ‘এই মুরগি, ‘এই মুরগি’ বলে। এরপর আর কৌতূহল সৃষ্টি হয় না। কিছু দিন আগে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে গাড়িতে করে আসছি। প্রেসক্লাবের সামন্যে মোল্লাদের সমাবেশ চলছে। গরম গরম জ্বালাময়ী বক্তৃতা হচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে। একজন বক্তা জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। বাসের মধ্য থেকেই তার বক্তব্য কানে আসল। তিনি বলছেন মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার অব্যাহত রাখে তাহলে তৌহিদী জনতা নাফ নদী পার হয়ে আরাকান রাজ্য দখল করে নেবে। ভাবলাম বাস্তবতা সম্পর্কে হুজুরদের জ্ঞান অনেকটাই কম। শাহীন রহমান [email protected] আম-কাঁঠালের ছুটির দরখাস্ত ২৬ মে, বৃহস্পতিবার, ২০১১। প্রায় বছর চারেক পর বেড়াতে গিয়েছি গ্রামের বাড়ি পুরান বাউশিয়ায় (মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানা)। লক্ষ্য আম ভক্ষণ। দুপুরবেলা নদীতে গিয়ে স্নান করলাম। বাড়ি ফিরে দেখি মা খাবার টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে বসে আছেন। দুপুরের ভাত প্রস্তুত। খাওয়ার পর মনভরে আম খেলাম গোটা ছয়েক। একটু পরেই বাড়ির উঠানে কার যেন হাঁকডাক শুনলাম। বের হয়ে দেখি এক আমগাছের বেপারি এসেছেন। সঙ্গে ট্রাক্টর। তাতে বড় আকারের টুকরি, দড়ি, বস্তা ও আম পারার লম্বা টোটা। মা জানালেন, বাবা আমাদের আমগাছের সব আম এই বেপারির কাছে বিক্রি করেছেন। চার হাজার টাকায়। এত অল্প দামে বিক্রি করায় তিনি নাকি ইতোমধ্যেই পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে সমালোচিত হয়েছেন! এদিকে বেপারির দুই সহকারী তর তর করে গাছে উঠে তাদের কার্যক্রম শুরু করে দিল। তাদের সঙ্গে আমিও উঠলাম (মা অবশ্য মানা করলেন)। উঠে একটা পাকা আম হাত দিয়ে পেড়ে গাছের ডালে বসেই খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষ হলে ফোন দিলাম জনকণ্ঠে আমার সহকর্মী জাহিদুল আলম জয়কে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছে, কুষ্টিয়া নিবাসী। মাথায় কিঞ্চিত চুলের অভাব। ওর চেহারার সঙ্গে স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার কোচ পেপ গার্দিওলার অসম্ভব মিল)। ‘রুমেল ভাই, আপনি কই?’ ‘আমগাছের ওপরে। আম্র ভক্ষণ করছি।’ ‘মানে?’ সব খুলে বললাম। সব শুনে জয়ের দাবি, ‘ঢাকা আসার সময় আমাদের সবার জন্য কিন্তু আম নিয়ে আসতে হবে!’ হঠাৎ মনে পড়ে গেল আম-কাঁঠালের ছুটির দরখাস্তের গল্পটি। ক্লাস নাইনের ঘটনা। প্রচ- গরম। আশপাশের স্কুল আম-কাঁঠালের বন্ধ দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের স্কুল বন্ধ হচ্ছে না। বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে হেড স্যারের কাছে একটি মজার দরখাস্ত নিয়ে তাঁর খাস কামরায় হাজির হলাম। তাতে লেখা (ভাষা পুরোপুরি মনে না থাকলেও সেটা অনেকটা এ রকমই)Ñ ‘জনাব, যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সবিনয় নিবেদন এই যে, আমরা আপনার অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি আমরা অতিশয় উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করিতেছি যে, দেশে প্রচ- উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করিতেছে। যাহাকে বলে ‘কাঠ ফাটা রোদ আর তালপাকা গরম।’ আর তাহার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দেশের সব ফল-ফলাদি, বিশেষ করিয়া আম্র ও কাঁঠাল রসে টইটুম্বুর হইয়া একেবারে পাকিয়া যাইতাছে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, আমাদের স্কুল ছুটি না থাকায় কেউই গ্রামের বাড়িতে গমন করিয়া তাহা আয়েশ করিয়া গলঃধকরণ করিতে পারিতেছি না। ইহার কারণে আমাদের সকলের চিত্ত নিদারুণ অশান্ত ও ব্যথিত পরিলক্ষিত হইতেছে। কাজেই, মহোদয় সমীপে আমাদের আকুল আবেদন বা একান্ত আরজ এই যে, আর কালবিলম্ব না করিয়া আমাদের আম্র-কাঁঠাল ভক্ষণ করিবার জন্য ছুটি প্রদান করুন ও আপনি নিজেও গ্রামের বাড়িতে গমন করিয়া আমাদের মতো ফল-ফলাদি আহার করিয়া চরম পরিতৃপ্তি লাভ করুন। পরিশেষে আমাদের ছুটি প্রদান করিয়া বাধিত করিবেন।’ হেড স্যার দরখাস্ত পড়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘এপ্লিকেশনের জন্য নয়, স্কুল এমনিতেই ছুটি দেয়া হবে। তবে সেটা পরশু থেকে। আম-কাঁঠালের বন্ধ। এখন যা ভাগ এখান থেকে!’ সন্ধ্যা নাগাদ গাছের সব আম পারা শেষ হলো। বাবা এগুলোকে পাঁচ ভাগ করে তা বিলি-বন্টন করলেন। আমাদের এক ভাগ, আমার দুই ফুফু ও দুই চাচা বাকি চার ভাগ। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে সারাদিনের ‘কর্মতৎপরতায়’। রাত আটটার মধ্যেই হাল্কা কিছু খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। এক ঘুমে রজনী পার। সকালে ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকে। সামনে এনে হাজির করালেন এমন একজনকে, যাকে দেখে আমি বিস্ময়ে হতভম্ভ ও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লাম। আরে, এ যে দীপা! ওর সঙ্গে দেখা হলো সুদীর্ঘ ২১ বছর পর! পছন্দের ছেলেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করায় তার বাবা তার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তাদের সন্তানাদিও হয়। তার পরও আমার ফুফার রাগ কমেনি। সে আরেক গল্প। দীপার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। তার চেয়ে তিন-চার বছরের ছোট। শৈশবে ওর সঙ্গে কত খেলাধুলা করেছি। অনেক স্মৃতি আছে। ওর বিদায়বেলায় মোবাইল ফোনে একসঙ্গে ছবি তুললাম। মায়ের কাছে শুনলাম, আমি গ্রামে এসেছি শুনেই নাকি ও আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। রাতটা কাটিয়ে পরদিন আবারও ঢাকা ফিরে এলাম। কিন্তু গ্রামে গিয়ে আম ভক্ষণের মধুর স্মৃতি ও নানা ঘটনার কথা মনে থাকবে অনেকদিন। রুমেল খান [email protected]
×