ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২১ আগস্ট হামলা মামলার যুক্তিতর্কে চীফ প্রসিকিউটর

নিরস্ত্র সমাবেশে গ্রেনেড হামলা উপমহাদেশে এটিই প্রথম

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭

নিরস্ত্র সমাবেশে গ্রেনেড হামলা উপমহাদেশে এটিই প্রথম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্পর্শকাতর ও বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের মামলার ২২তম দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। মামলার চীফ প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত সাক্ষ্যের আলোকে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এর আগেও নেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র চলছিল। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতেই এ হামলা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে চালানো হয়। বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন শেখ হাসিনা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা চাইলে তা নিয়ে তৎকালীন সরকার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। গ্রেনেড হামলা নিয়ে সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনতে চাইলে তৎকালীন সরকার বিদ্রপ করে। ঐ সময় সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ছিল না। আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী নিরস্ত্র গনতান্ত্রিক সমাবেশে সমরাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে হামলা এই উপমহাদেশে এটিই প্রথম। রাষ্ট্রপক্ষ এ সাক্ষ্য তুলে ধরে ক্ষতিগ্রস্ত ও স্বজন হারানোদের পক্ষে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করে। মামলার যুক্তিতর্ক আজ বুধবার আবার অনুষ্ঠিত হবে। রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার বিচার চলছে। চীফ প্রসিকিউটরকে যুক্তিতর্কে সহায়তা করেন এ্যাডভোকেট আকরাম উদ্দিন শ্যামল, এ্যাডভোকেট ফারহানা রেজা। এ ছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষে স্পেশাল পি.পি মোঃ আবু আব্দুল্লাহ্ ভুঞা , আবুল কালাম আজাদ, মোঃ আমিনুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে আসামিপক্ষে আইনজীবী আব্দুল সোবহান তরফদারসহ অন্যান্যরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী (পিডব্লিও) ১৬২ থেকে ২০৪ নং সাক্ষ্যের আলোকে যুক্তিতর্ক পেশ করা হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৫১১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির জ্যেষ্ঠ বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দসহ ২২৫ জনের সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামিপক্ষেও ২০ জন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ এসব সাক্ষ্য জেরা করেছে। চীফ প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান তার যুক্তিতর্কে বলেন, তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসভবনসহ বিভিন্ন স্থানে এ হামলার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করা হয়। মঙ্গলবার যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থাপিতদের সাক্ষীর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি, আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নির্মমতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণকারী আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান পুত্র নাজমুল হাসান (পাপন) এমপি’র জবানবন্দী। চীফ প্রসিকিউটর যুক্তিতর্কে আদালতকে বলেন , এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি-জামাত জোট সরকারের তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, হানিফ পরিবহনের হানিফ, জঙ্গী নেতা মুফতি হান্নান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক শহুদুল হক, পুলিশ কর্মকর্তা ওবায়দুল রহমান খানকে সম্পৃক্ত করে জবানবন্দি পেশ করেন। জবানবন্দিতে সাহারা খাতুন বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এর আগেও নেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে নানা ষড়যন্ত্র চলছিল। বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন শেখ হাসিনা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা চাইলে তা নিয়ে তৎকালীন সরকার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, সাক্ষী সাহারা খাতুন একজন ভিকটিম ও এ মামলার একজন বিচার প্রার্থীও। তিনি ২১ আগস্ট ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার সময় সমাবেশে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো লাঠি চার্জ করা হয়। এতে প্রতিয়মান হয় হামলাকারীদের নিরাপদ করতেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তৎকালীন সরকার পদক্ষেপ নেয়। যুক্তিতর্কে বলা হয় , বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আক্রান্তদের একজন। তার শরীরেও গ্রেনেডের ২৬টি স্প্রিন্টার বিদ্ধ ছিল। নিরস্ত্র গণতান্ত্রিক সমাবেশে সমরাস্ত্র দিয়ে হামলার ঘটনা উপমহাদেশে এটিই প্রথম ঘটনা। ওই সমাবেশে সে দিন তিনিও বক্তৃতা রাখেন। সমাবেশ চলাকালীন মঞ্চের সামনেই আইভি রহমানকে তিনি বসে থাকতে দেখেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে তিনি অস্থায়ী মঞ্চে শুয়ে পড়েন। প্রয়াত মেয়র হানিফসহ দলীয় নেতারা শেখ হাসিনাকে মানববর্মণ তৈরি করে নিরাপদে নিয়ে যান। পরে জ্ঞান ফিরলে উঠে দেখেন চারিদিকে বিভৎস ও ভয়াবহ অবস্থা। পরে তাকে সেখান থেকে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নেয়া হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনতে চাইলে তৎকালীন সরকার বিদ্রপ করে। যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, নাজমুল হাসান পাপন জবানবন্দিতে বলেন, ২১ আগস্ট ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে হতাহত মানুষের নির্মম পরিস্থিতি তার চোখে পড়ে। এক পাশে তার মা আইভি রহমানকে স্ট্রেচারে রাখা অবস্থায় দেখতে পান। এ পরিস্থিতি তার কাছে ছিল অকল্পনীয়। তখন পাপন বলেন, ‘আম্মা আমি চলে এসেছি তুমি কোন চিন্তা করো না।’ ঐ সময় সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ছিল না। পরে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তার মা আইভি রহমানকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যায়। সেখানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। গ্রেনেড হামলায় তার মার দু’টি পা উড়ে যায়। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত ছিল। ২৩ আগস্ট রাত তিনটার দিকে সিএমএইচ হাসপাতাল থেকে তাকে জানানো হয়, তার মা (আইভি রহমান) আর নেই। তার মা ২১ আগস্ট হামলার ভয়াবহ নির্মমতার শিকার।
×