ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আবদুল কুদ্দুস

মর্যাদার দ্বন্দ্ব এবং সাধারণ মানুষ

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

মর্যাদার দ্বন্দ্ব এবং সাধারণ মানুষ

সম্প্রতি দেশের পত্র-পত্রিকায় চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে মর্যাদার প্রশ্নে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আন্দোলনের খবর। তাই সরকার কর্তৃক তাঁদেরকে মর্যাদাবান করার জন্য গাড়ি বাড়ি ও চাকর-বাকরের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। এজন্য দেশের সাধারণ জনগণের করের অর্থ হতে ব্যয় করা হচ্ছে প্রায় ৪৬২ কোটি টাকা। গাড়ি-বাড়ি থাকলেই নাকি তাঁরা মর্যাদাবান হয়ে যাবেন! অন্যথায় অমর্যাদাবান! একটু ভিন্ন স্বার্থে দেশের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মচারীদের অমর্যাদার প্রশ্নে চলছে কাজ বাদ দিয়ে তুমুল আন্দোলন। এখানে তাঁদের স্বার্থ হলো ক্যাডার, নন-ক্যাডার। একটি দেশে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা মানে সেই দেশের উন্নয়ন হচ্ছে বলে আমি মনে করি। এটি দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণ বয়ে আনবে। কেননা, গ্রামের মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কিছুটা হলেও কমে আসবে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের অর্জিত অর্থ নিজ এলাকাতেই খরচ করতে পারবেন। ছেলেমেয়েদের কম খরচে সরকারী প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করাতে পারবেন। কিন্তু নতুন জাতীয়করণকৃত এসব প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষার প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে এমন ভাবনাও ঠিক নয়। সরকার সম্প্রতি দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বেসরকারী কলেজকে সরকারীকরণের কাজ হাতে নিয়েছে। বিষয়টি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নিকট অতিশয় আনন্দের। কিন্তু মর্যাদা-অমর্যাদার প্রশ্নে সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘নো বিসিএস, নো ক্যাডার’ স্লোগান সামনে রেখে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা দেশে জাতীয়করণ হতে যাওয়া শিক্ষকদের মর্যাদা কেমন হবে, ক্যাডার? না নন-ক্যাডার? এ বিষয়ক যে প্রশ্ন তুলেছেন সেই ভাবনা থেকেই আমার লেখার প্রয়াস। প্রথমেই বলে রাখি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সরকারী কর্মকর্তা বলে কোন ভাষা/শব্দ নেই। সংবিধানের নবম ভাগের বাংলাদেশের কর্মবিভাগের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘কর্মবিভাগে’ প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘কর্মচারী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই একটি শব্দই পারে উপর্যুক্ত সমস্যাটির সমাধান দিতে। মর্যাদা-অমর্যাদার প্রশ্ন প্রজাতন্ত্রের কোন কর্মচারীদের মনে আসত না যদি তাঁরা আমাদের বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে একটি শিক্ষা নিতে পারেন। শিক্ষাটি হলো বিশ্বের ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিলের অন্তর্ভুক্ত ৭ মার্চের ওই ভাষণের এক পর্যায়ে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’ বঙ্গবন্ধু নিজের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে চাননি। চাইলে জীবনের তেরটি বছর জেল না খেটে গদিতে বসেই জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করেছেন আমৃত্যু। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সকল নির্যাতনকে তিনি করেছেন বরণ। বাংলার মানুষকে ভালবেসে তিনি সব অপশক্তিকে করেছেন জয়। অতঃপর বাংলার মানুষ তাঁকে ভালবেসে অতি যতœ করে, বীরের মর্যাদা দিয়ে, গলায় ফুলের মালা পরিয়ে তাঁর না চাওয়া প্রধানন্ত্রীর আসনেই বসিয়েছেন। শিক্ষাজীবনে আমরা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আবদুল হাকিম, বেগম রোকেয়া সাখওয়াত হোসেন, গোলাম মোস্তফা, সুফিয়া কামালসহ বিসিএস পরীক্ষা থেকে মর্যাদাপ্রাপ্ত নয় এমন অনেক কবি সাহিত্যিক ও লেখকদের কালজয়ী লেখনী পড়েই তো আমাদের মধ্যে অনেকে আজ বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। নিজেদেরকে দাবি করছেন মহামর্যাদাবান হিসেবে। তবে ওই সমস্ত কবি সাহিত্যিকরা কী মর্যাদাহীন? অবশ্যই না। তাঁরা গাড়ি-বাড়ি, ক্যাডার নন-ক্যাডার সুবিধার প্রশ্ন না তুলে সারাটি জীবন ধরে নিঃস্বার্থভাবে দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। মানুষের দেওয়া সম্মানে তাঁরা আজ কালজয়ী এবং মহামর্যাদাবানই হয়েছেন। বিসিএস ক্যাডার, নন-ক্যাডার দ্বন্দ্বের যে প্রশ্ন উঠেছে তা কিন্তু বর্ণবাদ প্রশ্নের সঙ্গে মিল রয়েছে বলে আমি মনে করি। সাদা চামড়ার মানুষ হলে শ্রেষ্ঠ মানুষ আর কালো চামড়ার মানুষ নিচু শ্রেণীর এসব কথা কিন্তু বর্তমান মানবতাবাদী আধুনিক সমাজে একবারে মানায় না। এটি উচ্চারণ করা অপরাধ। এটি বলা পাপ যদি না হয় জগতে এর চেয়ে বড় অপরাধ ও পাপ কাজ আর নেই বলেও আমি মনে করি। মর্যদার যদি প্রশ্নই উঠে তবে চলুন একটি উদাহরণ বিবেচনা করি। এখান থেকে কিছুটা আমরা সাস্ত¡না পেতে পারি। উদাহরণটি হলো- সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় আইসিটি এক্সপো-২০১৭ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সেখানে মাত্র দুই বছরের একজন রোবট মানবী সোফিয়া টেক টক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমস্ত বাংলাদেশকে মাতিয়ে রেখে গেল। শুধু তাই নয়, সে ডেভিট জনসনের সুনিপণ হাতে হংকং-এ তৈরি হয়ে সৌদি আরবের নাগরিকত্ব পেয়েছে। যাই হোক ওই ডিজিটাল মেলায় সোফিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন প্রযুক্তিপ্রেমিক বাঙালীকে। সোফিয়া তো দুই বছরের একজন বাচ্চা মানবী। সে বিসিএস পাসের কোন কর্মকর্তা নয়। দুই বছরের অভিজ্ঞ বিসিএস ক্যাডারের কোন কর্মচারী পারবেন সোফিয়ার মতো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে? তবে মর্যাদার ব্যাপার কী শুধ্ইু চাকরি? নাকি আগামী প্রজন্মের জন্য গঠনমূলক কোন কাজ করা? অন্যদিকে বাংলাদেশের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী দেশের নাগরিক মর্যাদাকে পঁচিশটি স্তরে বিন্যাস্ত করা হয়েছে। এখানে যে পঁচিশ শ্রেণীর নাগরিক রয়েছেন তাতে বিসিএস শিক্ষা অথবা যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদার নিচের কর্মকর্তাদের নম্বর কত কেউ বলতে পারবেন? অথচ ওই তালিকায় নিরক্ষর একজন মানুষ তাঁর ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি হয়ে জনবান্ধব কাজের মাধ্যমে নিজের অবস্থান ওই পঁচিশ জনের সর্বোত্তমটাও তৈরি করে নিতে পারেন। পেয়েছেন এমন অনেক ইতিহাস বাংলাদেশেই আছে। দেশের রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের হিসাব খোলার ফরমে দেশের কোন ব্যক্তি গণ্যমান্য বলে পরিচত হবেন তার একটি তালিকা লাল ফন্টে বর্ণিত হয়েছে। এমন নির্দেশনা ভাল লক্ষণ নয়। এগুলো ইন্ডিকেটরস মানুষকে শুধু হিং¯্র হতেই শেখায়। কেননা প্রতিটি মানুষ সেই গণ্যমান্য স্তরে ওঠার জন্য নানারকম অপকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেশে অশান্তি তৈরি হয়। শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে। তাই আসুন শুধু পদের দ্বারা মর্যাদাবান না হওয়ার আশা না করে মহৎ কাজের মাধ্যমে মহামর্যাদাবান ও শ্রেষ্ঠ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হই। লেখক : শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
×