ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী ওয়াহিদুজ্জামান মিলন

অভিমত ॥ স্বাধীনতার পতাকা জাগ্রত থাকুক

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ স্বাধীনতার পতাকা জাগ্রত থাকুক

বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর, রাজা রায় বর্লভ, জগৎশেঠদের ষড়যন্ত্রে পলাশীর আ¤্রকাননে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। বাংলার ললাটে অঙ্কিত হয় পরাধীনতার কালিমা। হাস্যোজ্জ্বল বাংলার বদনখানি মলিন হয়। থেমে যায় পাখির কলরব। শৃঙ্খলিত হলো মুক্ত স্বাধীন বাংলা। ইংরেজদের নীলনক্সা ও বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলেও সেদিন দেশপ্রেমিক মানুষের আত্মত্যাগ বাংলার মানুষকে নতুন করে স্বাধীনতার নেশায় উজ্জীবিত করে। এরই ধারাবাহিকতায় তেভাগা আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ, নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, ব্রিটিশ পণ্য বর্জন তথা বাঙালী সব সময় স্বাধীনতার স্বপ্ন লালন করত। একসময় ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশের নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। আর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র। পূর্ববাংলা যুক্ত হয় পাকিস্তানের সঙ্গে। আবহমানকাল ধরে গড়ে ওঠা কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা গ্রাহ্য না করে সাত সমুদ্র তের নদী দূরত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শুধু ধর্মীয় কারণে পূর্ববাংলা অন্তর্ভুক্ত হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই পূর্ববাংলার মানুষের মোহ ভঙ্গ হয়। যেন বাঙালীর জন্ম হয়েছে আজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর বিদ্রোহ করার জন্য। বাঙালী পুড়ে ছারখার হবে তবুও মাথা নোয়াবে না। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী প্রথম আঘাত হানে আমার মায়ের মুখের ভাষা বাংলার ওপর। কেড়ে নিতে চায় মায়ের ভাষাকে, জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন জাতির জন্য গৌরবোজ্জ্বল স্মরণীয় ঘটনা যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ’৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার তরুণ ছাত্র সমাজ বুলেটের মুখে বুক পেতে দিয়ে তাজা রক্তের আলপনায় ঢাকার রাজপথে অঙ্কন করে আমারই রাষ্ট্র ভাষা বাংলাকে। বাঙালীই একমাত্র জাতি যে জাতি রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করেছে। ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিচঢালা পথ রক্তে রঞ্জিত করে আতুর ঘরে স্বাধীনতার যে বীজ বপন হয়েছিল তা বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে জাতির সামনে আবির্ভূত হয় স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, কথা বলার অধিকার, সর্বোপরী গণতন্ত্র। বাঙালী যখন রক্ত দিয়ে আইনগতভাবে অধিকার আদায়ে একতাবদ্ধভাবে অবিচল, তখন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় কালক্ষেপণ করে পরিকল্পনা করে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের। একপর্যায়ে ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত্রিতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর পাকিস্তানীরা হানে ইতিহাসে ন্যক্কারজনক সশস্ত্র হামলা। তবুও বাঙালী দমবার নয়। তৎকালীন বাঙালী সেনাসদস্য, পুলিশ, ইপিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সঙ্গে বাংলার ছাত্র জনতা তথা আপামর জনগণ হাতে হাত রেখে শপথ নেয়, জীবন দেব তবুও দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালী পায় স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব লাভ করে বাংলাদেশ। সবুজের মাঝে লাল বৃত্তের পতাকা বাতাসে পতপত করে উড়ে স্মরণ করিয়ে দেয়, এই পতাকা বা স্বাধীনতা কারও দান নয়, রক্তে কেনা আমার এ স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মূল মন্ত্র সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। বিবর্তনের ধারায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা সঙ্গে মৌলিক অধিকারে যুক্ত হয়েছে যোগ্যতানুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করা, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে জাতির সামনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- আমরা কি আজও স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত সুফল জনগণকে উপহার দিতে পেরেছি? আমরা অল্প কয়েক বছরের মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি। একথা সত্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। সামন্তবাদী যুগের অবসান হতে চলেছে প্রতিনিয়ত। এখন আর এক রাজ্য কর্তৃক অন্য রাজ্য জবর দখল করে না। ভিন্ন মোড়কে বা কৌশলে এক রাজ্য অন্য রাজ্যের উপর বাণিজ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে যাকে বলে অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার। দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মীর জাফররা সিরাজউদৌলার শাসন আমলেও ছিল এখনও বিরাজমান। সুযোগ পেলেই এরা আপনজনেরও ক্ষতি করবে। তাই বিজয়ের মাসে সবাইকে শপথ নিতে হবে- স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে কাজ করতে হবে সবাইকে একসাথে, তবেই জয় নিশ্চিত। মনে রাখতে হবে অরক্ষিত স্বাধীনতা এক প্রকার পরাধীনতাবই বটে। ব্যক্তি স্বার্থ নয় চাই আইনের শাসন। সবার আগে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের মর্যাদা। স্বাধীনতার পতাকা চির জাগ্রত থাকুক এদেশে মাটিতে, এদেশের মানুষের প্রাণে। লেখক : কবি
×