ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থাপনা নির্মাণ ॥ ধ্বংস হচ্ছে বন

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থাপনা নির্মাণ ॥ ধ্বংস হচ্ছে বন

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ক্যাম্পে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতে কাঠ সরবরাহ করতে কতিপয় এনজিওর লোভনীয় অফার (অধিক মূল্য) পেয়ে বনজ সম্পদ ও সামাজিক বনায়ন ধ্বংস করে দিচ্ছে এক শ্রেণীর কাঠচোরের দল। উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে বিভিন্ন এনজিও, আইএনজিও এবং ব্যক্তি বিশেষের নামে চ্যারিটরি সংস্থার লোভনীয় ওই অফারে ধ্বংস হচ্ছে বনায়নের বাকি অংশটুকুও। ইতিপূর্বে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে উড়ে এসে জুড়ে বসার মত যে যেখানে ইচ্ছে বনের সৃজিত বাগান ধ্বংস ও পাহাড় কেটে ঝুপড়ি তৈরিতে বনজ সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে। বর্তমানে ওই রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণকল্পে কিছু কিছু এনজিওর (প্রজেক্ট) কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ঠিকাদার দিয়ে কেটে নেয়া হচ্ছে বনের গাছ। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্বের ক্ষতি করে চলছে তারা। সূত্র জানায়, ওই সব সংস্থার অর্থায়নে রোহিঙ্গাদের শেড তৈরি, মেডিক্যাল সেন্টার, নারী বান্ধক কেন্দ্র, শিশু বিকাশ কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে হাজার হাজার ঘনফুট অবৈধ কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। বনজসম্পদ এমনকি সামাজিক বনায়নের গাছও কেটে প্রকাশ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আনা হচ্ছে প্রতিদিন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যবহৃত কাঠের কোন পারমিট বা বৈধতা নেই বলে জানিয়েছেন বনবিভাগের কর্মকর্তাগণ। রোহিঙ্গাদের মানবতার দোহাই দিয়ে উখিয়া টেকনাফে ১২টি অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বনজসম্পদ বিনাশ করে ফেলা হচ্ছে। পারমিট দেয়া কাঠ কিনলে উচ্চ দামে কিনতে হয় বলে ঠিকাদার নামধারী অসাধু ব্যবসায়ীরা কাঠচোরের কাছ থেকে অল্পদামে কিনে ওই সব কাঠ অধিক মূল্যে সরবরাহ দিচ্ছে এনজিওর প্রতিনিধিদের কাছে। ওই ক্যাম্প গুলোতে প্রায় ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রিত রয়েছে। তারাও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে বনের কচিচারা গাছ। জানা যায়, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবায় সরকারের পাশাপাশি ৭৪টি আইএনজিও এবং এনজিও সংস্থা কাজ করছে। প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এসব দেশী-বিদেশী সংস্থা গুলোকে কাজ করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কিন্তু তাদের ওসব স্থাপনা নির্মাণে কোথা থেকে কাঠ সংগ্রহ করবে, তা জেলা প্রশাসককে না জানিয়ে বনাঞ্চল নিধন করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবিক সেবায় নিয়োজিত দেশী-বিদেশী কতিপয় এনজিও নানা রকম প্রকল্প ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার নামে অবৈধ কাঠ ব্যবহার করে চলছে। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার জন্য ১ হাজারের অধিক শিশু শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা হচ্ছে। এছাড়াও স্বাস্থ্য সেবায় মেডিক্যাল সেন্টারসহ স্যানিটেশন, নলকূপ স্থাপন ও বাথরুম নির্মাণ করার কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ কাঠ। ওসব প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণে হাজার হাজার ঘনফুট অবৈধ কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। অভিযোগ প্রকাশ, এনজিও সংস্থা পালস বাংলাদেশ, কোডেক, ব্র্যাক, ইউনিসেফ, অক্সফাম, মুক্তি, কোস্টট্রাস্ট, কর্নসান, এমএসএফ ও আলহাজ ফয়েজ উল্লাহ ফাউন্ডেশনসহ দেশী-বিদেশী একাধিক এনজিও সংস্থা উখিয়ার কুতুপালং, মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, বালুখালী, থাইংখালী, ময়নার ঘোনা, জামতলী, পালংখালী, টেকনাফের লেদা ও নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ১ হাজারের মত শিশু বিকাশ কেন্দ্র এবং শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করছে। ওসব কেন্দ্র নির্মাণে হাজার হাজার ঘনফুট অবৈধ কাঠ ব্যবহার করায় একদিকে যেমন বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে, অপরদিকে এখাতে সরকার হারাতে বসেছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। বনবিভাগের নমনীয়তার সুযোগে ওসব গাছ কেটে পার্শ্ববর্তী স’মিল থেকে চিরাই করে জিপ-পিকআপ ও ট্র্র্র্র্রাক যোগে রাতের বেলায় কিছু কিছু ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাতে সড়কে টহলরত পুলিশকে ম্যানেজ করে অবৈধ কাঠভর্তি গাড়িগুলো অনায়াসে ঢুকে পড়ছে ক্যাম্পগুলোতে। পরদিন সকালে বনবিভাগের অসৎ কর্মচারীরা গিয়ে গাছ অনুপাতে নগদ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচর-ঠেঙ্গারচরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে ধারণায় তড়িঘড়ি করে স্বার্থান্বেষী মহল অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে। যাতে এতগুলো স্থাপনা ভাঙ্গার চাইতে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর না করা শ্রেয় মর্মে সরকারকে ধারণা দিতে পারে। সচেতন মহলের অভিযোগ, হাজার হাজার ঘনফুট অবৈধ কাঠ দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করার কারণে সংরক্ষিত বনায়ন ধ্বংসের দার প্রান্তে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, এভাবে ক্যাম্পে অবৈধ কাঠ ব্যবহার হতে থাকলে উখিয়া-টেকনাফের সংরক্ষিত পুরো বনাঞ্চলের অস্তিত্বও থাকবে না। কোন অবৈধ কাঠ সংগ্রহ করি না দাবি করে কয়েকজন এনজিও কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রসহ নানা স্থাপনা তৈরির জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়েছে। ঠিকাদারগণ নির্মাণ কাজে কোথা থেকে কাঠ সংগ্রহ করে থাকে, সেটি তারা বুঝবে। আমরা শুধু বিল পরিশোধ করব। সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে সমিল হতে চিরাই করে প্রকাশ্যে কাঠগুলো সরবরাহ করা হলেও স্থানীয় বনবিভাগ এ কাজে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে। ঠিকাদার নামধারী কাঠচোরের দল বনবিভাগের কর্মচারীদের কাছে সরকারী দলের চট্টগ্রামের একজন এমপির পরিচালনাধীন একটি এনজিওর নাম ভাঙ্গিয়ে ধমক দিয়ে থাকে বলে জানা গেছে। কতিপয় এনজিও কর্মকর্তা ও ঠিকাদার ক্যাম্পে দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসনের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা ও স্থানীয় বনবিভাগকে ম্যানেজ করে ফ্রিস্টাইলে হাজার হাজার ঘনফুট অবৈধ কাঠ ব্যবহার করছে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবার নামে এনজিও সংস্থার অর্থায়নে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে বনায়ন ধ্বংস ছাড়াও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সচেতন মহল। তারা রোহিঙ্গাদের হয়ত স্বদেশে ফেরত নতুবা দেশের অন্য কোথাও স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন।
×