ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আনাইয়ের সুনীল স্বপ্ন...

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

আনাইয়ের সুনীল স্বপ্ন...

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ বড্ড লাজুক এক কিশোরী। মাথার চুল ছেলেদের মতো ছোট করে কাটা। অথচ ডিফেন্ডার হিসেবে যখন মাঠে ফুটবল খেলতে নামে, তখন তাকে আগের স্বভাবের সঙ্গে মোটেও মেলানো যায় না। প্রতিপক্ষ দলের ফরোয়ার্ডদের রুখে দেয় নিপুণভাবে। করে কড়া ট্যাকলিং। মত চাপেও ঠা-া থাকে বরফের মতো ঠা-া। নিজ দায়িত্ব পালনে তার জুড়ি নেই। আত্মবিশ্বাসই তার মূল অস্ত্র। কখনই ঘাবড়ায় না সে। নামটি তার আনাই মগিনি। বাংলাদেশ অনুর্ধ ১৫ জাতীয় মহিলা দলের ফুটবলার। অনেকেই মজা করে বলেন, ‘ডিফেন্ডার আনাই, তার সামনে ফরোয়ার্ডরা করে না ধানাই-পানাই!’ ঢাকায় চলমান সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেদের প্রথম খেলায় স্বাগতিক বাংলাদেশ ৬-০ গোলে উড়িয়ে দেয় নেপালকে। এই ম্যাচে নেপাল অল্প কিছু আক্রমণ করলেও সেগুলো নসাৎ করতে যার ভূমিকা ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, সে আনাই। এই ম্যাচে আনাইয়ের যমজ বোন আনুচিং মগিনিও খেলেছে ফরোয়ার্ড হিসেবে। দুটো গোলও করেছে। আনাই ও আনুচিং জমজ বোন। দুজনের বয়সের ব্যবধান মাত্র পাঁচ মিনিট! যমজ হলেও দুজনের স্বভাব ভিন্ন। আনুচিং মোটামুটি কথা বললেও আনাই আবার দারুণ স্বল্পভাষী। তবে সে একজন মনোযোগী শ্রোতা। যখন তার পায়ে বল থাকে, তখন বেশ নিশ্চিন্তেই থাকেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। দলের প্রয়োজনে আনাইকে স্টপার কিংবা রাইট ব্যাকÑ দুই পজিশনেই খেলান ছোটন। তাজিকিস্তানে গিয়ে গ্রুপ পর্বে নেপালকে ৯-০ গোলে হারানোর ম্যাচে ডিফেন্ডার আনাইয়েরও একটি গোল ছিল। খাগড়াছড়ি শহর থেকে দুই কিলোমিটার রাস্তা। তারপর সাতভাইয়া পাড়া। সেখানেই আনাইয়ের জন্ম। তাদের বাড়ির উঠানে লাগানো আছে এক জোড়া নারিকেল গাছ। সেই নারিকেল গাছ দুটোও আনাইদের মতো জমজ! আনাইরা চার বোন, তিন ভাই তারা। আনাই ষষ্ঠ। বাবা রিপ্রু মগী একজন কৃষক। মাঝে মধ্যে বনজ ঔষধ বিক্রি করে সংসার চালান। একটি বাড়ি ছাড়া তেমন কোন জমিজমা নেই। সেই বাড়ি ২০১২ সালে আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। আগে দিনমজুরি করতেন। মা আপ্রুমা মগিনি গৃহিণী। মোট কথাÑ সংসারের অবস্থা ছিল শোচনীয়। তবে সেই দুরবস্থা থেকে অনেকটাই উত্তরণ ঘটেছে আনাই-আনুচিংয়ের ফুটবল খেলার মাধ্যমে। আনাইয়ের ফুটবলার হওয়ার গল্পটা কেমন? সোমবার অনুশীলন শেষে বাফুফে টার্ফে বসে রাঙামাটি গাগরা হাই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী আনাই জানায়, ‘বাড়ির উঠানে ভাইরা ফুটবল খেলত। তাদের সঙ্গে আমিও আগ্রহ নিয়ে খেলতাম। এছাড়াও পাড়ায় ছেলেদের সঙ্গে খেলেছি। এজন্য অবশ্য মা-বাবা কখনও আমাকে বাধা দেননি। বরং সবসময় উৎসাহই দিয়েছেন।’ তবে আনাই সিরিয়াসলি ফুটবল খেলা শুরু করে ২০১১ সালে। তখন সে ক্লাস ফোরে পড়ে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্টের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে। রাঙ্গামাটি মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে অংশ নিয়ে সেবার আনাইদের দল রানার্সআপ হয়। এর আগে সে পড়ত সাতভাইয়া পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর খাগড়াছড়ির তাদের জেলা মহিলা ফুটবলে দল না করাতে দুই বোন ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জের হয়ে জাতীয় পর্যায়ের ফুটবলে নাম লেখায়। শুরু থেকেই ডিফেন্ডার হিসেবে খেলত আনাই। সবাই বলত এই পজিশনেই খেলতে। দেশে কৃষ্ণা রানী সরকার এবং বিদেশে লিওনেল মেসির ভক্ত আনাইয়ের স্বপ্ন দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতা। ‘আমি সাফ ফুটবল, এসএ গেমসে ফুটবলে বাংলাদেশের হয়ে শিরোপা জিততে চাই। তবে তার আগে আপাতত জিততে চাই সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা।’ ফুটবল খেলার সুবাদে এ পর্যন্ত সাত দেশে ভ্রমণ করা আনাইয়ের (তাজিকিস্তান, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যন্ড) শখ অবসরে হুমায়ূন আহমেদের বই পড়া আর ক্যাম্পে থাকলে সতীর্থদের সঙ্গে মজা করা।
×