ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মহিউদ্দিনের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতে গিয়েই প্রাণ গেল তাদের

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

মহিউদ্দিনের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতে গিয়েই প্রাণ গেল তাদের

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তার বাসায় গিয়ে কেউ না খেয়ে ফেরেনি। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানকে তিনি সারাদেশে পরিচিত করিয়েছিলেন। অথচ কী দুর্ভাগ্য, চট্টলাবাসীর প্রিয় এ নেতার কুলখানিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল দশটি তাজা প্রাণ। মেজবানের খাওয়ার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় নেতা মহিউদ্দিনকে ঘিরে জনমানুষের আবেগ। মূলত সেই আবেগ নিয়েই কুলখানিতে দলে দলে মানুষের ছুটে যাওয়া। মৃত্যুর আগেই তার বাসভবনে এবং হাসপাতালে মানুষের ভিড় যেমন লক্ষ্যণীয় ছিল, তেমনি তার জানাজায় লাখও মানুষের ঢল ছিল বিস্ময়কর। অতি আপন এই নেতার কুলখানির জন্য আয়োজিত ১৪টি স্থানে অনুরূপভাবে জনমানুষের ঢল নেমেছিল সোমবার। যে কারণে মানুষের তাড়াহুড়ো ও ধাক্কাধাক্কির জের হিসেবে মহিউদ্দিনের অতি শুভাকাক্সক্ষী লাখও মানুষের মধ্যে ভিড়ের চাপে প্রাণ হারালেন তারা। চট্টগ্রাম নগরীর শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ রোডের আসকারদীঘির পাড় এলাকায় রীমা কনভেনশন হলে সোমবার দুপুরে ঘটে মর্মান্তিক এই ঘটনা। মহানগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানি উপলক্ষে এখানে ছিল ভোজের আয়োজন। নগরীর ১৪টি কমিউনিটি সেন্টারে অন্তত দেড় লাখ মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে রীমা সেন্টারে ব্যবস্থা ছিল হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য। সবকিছু চলছিল ঠিকমতোই। কিন্তু বেলা ১টা ৪০ মিনিট হতে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই প- হয়ে যায় সবকিছু। জনমানুষের এই প্রিয় নেতার কুলখানির আয়োজনে এসে এমন মর্মন্তুদ পরিণতিকে বরণ করতে হবে, তা কে জানত। একটি শোকের ঘা না কাটতেই আরও একটি শোকাবহ ঘটনার সৃষ্টি হল। প্রবেশপথে চাপের মুখে পদদলিত হয় ৪০ থেকে ৫০ জন। আহতদের দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। এরমধ্যে মৃত্যুকে বরণ করে নেয় দশ জন। রীমা কনভেনশন হল এবং হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে কান্নার রোলে। চলতে থাকে হতাহতদের স্বজনদের আহাজারি। আকস্মিক এ ঘটনায় হাসপাতাল এবং অকুস্থলে ছুটে যান প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা সকলেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। হৃদয়বিদারক এ ঘটনার জন্য কেউ যেমন প্রস্তুত ছিল না, তেমনিভাবে এর জন্য কোন সান্ত¦নাও নেই। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও। তারও সংজ্ঞা হারাবার অবস্থা। তাকেও চিকিৎসা নিতে হয়। রীমা কনভেনশন সেন্টারের প্রবেশ পথে এলোপাতাড়ি পড়ে থাকে হতাহতদের দেহ। স্বেচ্ছাসেবক এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যান। বন্ধ হয়ে যায় খাওয়া দাওয়ার সে আয়োজন, যা চলছিল বেলা ১১টা থেকে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে ছিল এ আয়োজন। একে সফল করতে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না কর্মী সমর্থকদেরও। কোন ধরনের উচ্ছৃঙ্খল কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনায় ভ-ুল হয়েছে, এমনটি মনে করছেন না আয়োজকরা। বিষয়টিকে তারা দেখছেন দুর্ভাগ্য হিসেবে। এ ঘটনা তাদের প্রিয় নেতা হারানোর মনোকষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রীমা কনভেনশন সেন্টারে উপস্থিত শিবু দাশগুপ্ত বলেন, আসলে এ ভিড় মূলত খাওয়ার জন্য নয়। আয়োজনটি যে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে কেন্দ্র করে। তার প্রিয় চট্টগ্রামের মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। কেননা, জীবদ্দশাতে তিনি বলতে গেলে সারাজীবনই মানুষকে খাইয়ে গেছেন। তার মৃত্যুর এ আয়োজনে মানুষ এসেছে স্রোতের মতো। কিন্তু তাও সমস্যা ছিল না। কমিউনিটি সেন্টারের গেট থেকে প্রবেশের পথটি বেশি ঢালু হওয়ায় এ ঘটনা ঘটে গেছে। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট সুনীল সরকার বলেন, দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী-বা বলতে পারি। সান্ত¦না খুঁজে পাওয়ার কোন ভাষা নেই। এটি কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী ছিল না। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় নেতা এবং সাবেক মেয়র। তিনি মানুষকে খাওয়াতে ভালবাসতেন বলেই তার কুলখানিতে নগরজুড়ে এত বড় আয়োজন ছিল। তিনি জানান, রীমা কনভেনশন সেন্টারে সাত হাজার মানুষের খাবারের ব্যবস্থা ছিল। এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার লোকের খাওয়া হয়েও গিয়েছিল। শৃঙ্খলা রক্ষায় যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে পুলিশ। সে কারণে তাদেরও দায়ী করতে চাই না। তিনি বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল। সকলকেই খাওয়ানো যেত। ‘কিন্তু সবই আমাদের দুর্ভাগ্য’Ñ এই বলে তিনি আক্ষেপ করেন। সিএমপির অতিরিক্ত উপ কমিশনার (দক্ষিণ) আবদুর রউফ বলেন, ঘটনার নেপথ্যে কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ কেউ করেনি। একটি ব্যাচের খাওয়া হলে আরেকটি ব্যাচ ঢোকানো হচ্ছিল। ভেতরে যখন খাওয়া চলছিল তখন বাইরে অপেক্ষমাণ ছিল আরও মানুষ। তারা ছিল গেট বরাবর দাঁড়িয়ে। বাইরে থেকে অনেকেরই জানার কথা নয় যে, প্রবেশের পথটা এতটা ঢালু। চাপের কারণে কয়েকজন পড়ে গেলে আরও পড়তে থাকে। এভাবে পদপিষ্ট হয় ৪০ থেকে ৫০ জন। সেখানে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট এই কমিউনিটি সেন্টারে খাবারের আয়োজন হলেও সেখানে অনেক মুসলিমও গিয়েছিলেন। এদের অনেকে যান না জেনে। আবার অনেকে যান কাছের কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে। এর ফলে সেখানে অত্যধিক চাপ পড়ে। এদিকে হতাহতদের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় সবকিছু করার আশ্বাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রতি পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা এবং আহতদের ৫ হাজার টাকা করে প্রদান করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিহত প্রতি পরিবারকে ১ লাখ টাকা করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। তাছাড়া মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকেও সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি এবং আওয়ামী লীগ নেতারা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ এবং স্বজনহারা পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
×