ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে রাস্তায় প্রাণ গেল শিশুর

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে রাস্তায় প্রাণ গেল শিশুর

স্টাফ রিপোর্টার \ মাদকাসক্ত সৎ ভাইয়ের পর এবার রাজধানীতেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নির্মমভাবে প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে রাস্তায় প্রাণ গেল এক শিশুর। এক সন্তানকে চিকিৎসা করতে ঢাকায় আসেন মা আকলিমা। রিক্সায় ওঠার পর ছিনতাইকারী মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিলে কোলে থাকা শিশু সন্তান পাকা রাস্তার উপর পড়ে যায়। ক্ষতবিক্ষত হয় মুখ ও মাথা। মুহূর্তেই নিষ্পাপ শিশুর তাজা রক্তে পিচ ঢালা পথ লাল হয়ে যায়। মাসহ শত শত মানুষের সামনেই ছটফট করতে করতে রাস্তায়ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে পাঁচ মাসের শিশু আরাফাত। এমন দৃশ্য দেখেই মা অজ্ঞান হয়ে যান। অনেকেই যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাদেরও জ্ঞান হারানোর অবস্থা হয়। সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা। শেষ পর্যন্ত ছেলেকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে ফিরিয়ে নেয়ার পরিবর্তে এক ছেলের লাশ আর অন্য ছেলেকে অসুস্থ অবস্থায়ই নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে পরিবারটিকে। সোমবার ভোর সোয়া ছয়টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন দয়াগঞ্জ রেলসেতুর মাত্র একশ’ গজ পূর্ব দিকে ঘটনাটি ঘটে। নিহত আরাফাতের বয়স পাঁচ মাস। তার বড় ভাই আল আমিন। তার বয়স চার বছর। আল আমিন গত দুই বছর ধরে অসুস্থ। তাদের বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলার নরসিংপুর গ্রামে। আরাফাতের পিতার নাম শাহ আলম গাজী। তিনি গ্রামেই থাকেন। দিনমুজুর। মা আকলিমা বেগম গৃহিণী। কোন মতে তাদের সংসার চলে। অসুস্থ বড় ছেলে আল আমিনকে চিকিৎসা করানোর জন্য তারা সপরিবারে ঢাকায় আসেন। লঞ্চে করে ঢাকায় এসে ভোরে নামেন সদরঘাটে। সূর্য উঠলে তারা রিক্সায় করে যাত্রাবাড়ী থানাধীন শনির আখড়ায় তাদের বোনের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। পিতার কোলে ছিল বড় ছেলে। আর মায়ের কোলে ছিল ছোট ছেলে আরাফাত। বোনের বাসায় খাওয়া-দাওয়া ও সামান্য বিশ্রাম নেবেন। এরপর তাদের শেরে বাংলানগর শিশু হাসপাতালে আল আমিনকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিধি বাম। রিক্সায় করে যাচ্ছিলেন ভালই। দয়াগঞ্জ রেলসেতুর পূর্বপাশে যাওয়ার পর ঘটে যায় সেই হৃদয় বিদারক ঘটনাটি। আচমকা ২০/২৫ বছর বয়সী এক যুবক ছিনতাইকারী আরাফাতের মায়ের কাঁধে ঝুঁলে থাকা ব্যাগ হেচকা টানে ছিনিয়ে নেয়। প্রচন্ড গতিতে ব্যাগ ধরে টান মারায়, ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেসামাল হয়ে পড়েন মা আকলিমা বেগম। এ সময় তার কোলে থাকা পাঁচ মাসের শিশু আরাফাত নিচে পাকা রাস্তার উপর ছিটকে পড়ে। মুহূর্তেই নাক ও মাথা থেতলে যায়। প্রচন্ড আঘাতে মাথা ফেঁটে গল গল করে রক্ত বের হতে থাকে। শিশু চিৎকারে সেখানে জড়ো হয় শত শত মানুষ। মাত্র কয়েক মিনিটে কোমলমতি নিষ্পাপ শিশুর তাজা রক্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো রাস্তা। শত শত মানুষের সামনে ছটফট করতে করতেই মৃত্যু হয় আরাফাতের। এমন দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে যায় পিতা মাতার। একমাত্র ভাই আল আমিন নির্বাক ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। উপস্থিত জনতা এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন। মর্মান্তিক এমন ঘটনায় মায়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। শিশুটিকে দ্রত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তার আগেই পরপারে চলে যায় শিশুটি। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আরাফাতকে মৃত ঘোষণা করেন। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আনিছুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এ ব্যাপারে অজ্ঞাত ছিনতাইকারীদের আসামি করে নিহত আরাফাতের পিতা একটি মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। সোমবার বিকেলে আরাফাতের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশ নিয়ে তারা গ্রামের বাড়ি গেছেন। এর আগে গত ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরখানে ঘুমের সামান্য ব্যাঘাত ঘটায় সিমরান নামের সাত বছর বয়সী এক শিশু নির্মমভাবে গলাটিপে শ্বাসরোধে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয় তারই সৎ ভাইয়ের হাতে। ওই শিশুকে ডেকে নিয়ে হত্যার পর লাশ নৌকার পাটাতনের নিচে ফেলে দেয় পাষন্ড খুনি। খুনি সৎ ভাই বাপ্পী (২২) হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের অক্টোবরে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার যোশর ইউনিয়নের খৈনকুট গ্রামের একটি কাঁঠাল বাগানে মোছাঃ আজিজা খাতুন (১৩) নামের খনকুট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করে তারই চাচির নির্দেশে। চাচির পরকীয়ার সর্ম্পকের জেরে অবৈধ মেলামেশা দেখে ফেলায় এমন নির্মম পরিণতি হয় আজিজার। এছাড়া গত বছর খুলনায় শিশু রাকিবকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা। সিলেটে শিশু রাজনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা, হবিগঞ্জের বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রাম থেকে স্কুলছাত্র শুভ, তাজেল, মনির ও মাদ্রাসা ছাত্র ইসমাইলকে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা, গরু চোর ভেবে চার ঘণ্টার নির্যাতনের পর হাত পা বেঁধে রাজধানীর দক্ষিণ থানাধীন এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া কালিগঞ্জের বালু নদীতে ফেলে দিয়ে কিশোর নিজাম উদ্দিনকে হত্যা, কুমিল্লার সদরের দক্ষিণ উপজেলাধীন দক্ষিণ রসুলপুরের ঢুলিপাড়ায় সহোদর মেহেদী হাসান জয় (৭) ও মেজবাউল হক মনিকে (৫) গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। শিশু নির্যাতনের বিষয়ে বিশিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলছেন, পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় যারা পিছিয়ে থাকে তাদের মধ্যে জেদ, মন কষাকষি, ক্ষোভ, না পাওয়ার ক্রোধ ও আফসোসসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এসব ক্ষোভ থেকেই অনেকেই প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যাদের উপর ক্ষোভ থাকে, তাদের ঘায়েল করার জন্য দুর্বল পয়েন্ট হিসেবে তাদেরই শিশু কিশোররা টার্গেট হয়ে থাকে। আর ক্ষোভের প্রধান টার্গেট হয় কোমলমতি শিশু কিশোররা। প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতেও জেদ বা রাগের বশবর্তী হয়ে পরিকল্পিতভাবে শিশু নির্যাতন বা হত্যাকান্ডের মত মারাত্মক সব অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই শিশুরা শিকারে পরিণত হয়। সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এসব অপরাধ সমাজ থেকে দূর করা কঠিন। পাশাপাশি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরী। ইতোমধ্যেই বিচার বিভাগ এ ধরনের অনেক মামলার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক রায় দিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকতে হবে।
×