ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁর ‘আতাইকুলা বধ্যভ‚মি’

৫২ শহীদের গণকবর আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

৫২ শহীদের গণকবর আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ

বিশ্বজিৎ মনি ॥ নওগাঁর রানীনগর উপজেলার ‘আতাইকুলা’ বধ্যভূমি পার হয়েছে স্বাধীনতার ৪৬ বছর। কিন্তু কোন উন্নয়ন হয়নি আজও। সরকারীভাবে সংরক্ষণেরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ৫২ শহীদের পরিবার পায়নি কোন সাহায্য সহায়তা। জোটেনি কোন বিধবাভাতা বা বয়স্কভাতা। সন্তান-সন্ততিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শহীদদের অনেকেই বাড়ি বাড়ি ঝি-এর কাজ করছেন। নিজেদের উদ্যোগে কোন রকমে ইটের প্রাচীর দিয়ে ৫২ শহীদের সমাধিস্থল ঘিরে রেখেছেন তারা। শহীদদের স্মৃতিরক্ষায় এলাকাবাসী ও শহীদ পরিবারের দীর্ঘদিনের দাবি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের। কিন্তু সে দাবি শুধু দাবিই রয়ে গেছে। ওই দিনের নারকীয় ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান আতাইকুলা গ্রামের প্রদ্যুত কুমার পাল, সাধন চন্দ্র পাল ও নিখিল চন্দ্র পাল। হত্যাযজ্ঞের কাহিনী অশ্রসিক্ত নয়নে বর্ণনা করে তারা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল (রবিবার) সকাল ১০টায় স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় কুজাইল বাজারের ঘাটে ছোট যমুনা নদী পার হয়ে আসে একদল হানাদার বাহিনী। ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আছে বলে তাদের আনা হয় সেখানে। গ্রামটি ঘিরে ফেলে, প্রতিটি বাড়ি থেকে নগদ টাকা স্বর্ণালঙ্কারসহ মাল লুট করা হয়। নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে গ্রামের বলরাম চন্দ্রের বাড়ির উঠানে নিয়ে যায়। সেখানে পুরুষদের উঠানে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করে রাখে। আর উঠানের পাশেই নারীদের একটি ঘরে রাখা হয়। একের পর এক নারীদের ওপরে চলে পাশবিক নির্যাতন। পরে সারিবদ্ধ পুরুষদের ওপর চলে পাকি হানাদার বাহিনীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্রাশফায়ার। মুহ‚র্তের মধ্যেই ৫২ জন শহীদ হন। পরে তারা বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে চলে যায়। শহীদদের মধ্য থেকে গুলিবিদ্ধ হয়েও কোন রকমে বেঁচে যান প্রদ্যুত পাল, সাধন পাল ও নিখিল পাল। প্রদ্যুত পাল জানান, ওই দিন তার বাবা, কাকা, জ্যাঠা এবং গ্রামের লোকজনের সঙ্গে তাকেও সারিবদ্ধ করে ব্রাশফায়ার করা হয়। মুহ‚র্তের মধ্যে প্রাণ হারান ৫২ মুক্তিকামী মানুষ। হানাদার বাহিনীরা চলে যাবার পর রক্তাক্ত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লাশের মধ্য থেকে কোন রকমে বেঁচে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পাশেই তার বাড়িতে যান। তিনি জানান, সবাইকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়েছি। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হলেও কোন সরকারের আমলে কোন শহীদ পরিবারে এখনও কোন সাহায্য সহায়তা মেলেনি। কোন স্মৃতিস্তম্ভও গড়ে ওঠেনি সেখানে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেগম শাহিন মনোয়ারা হক এমপি নিজ উদ্যোগে কিছু অনুদান দিয়ে একটি ফলকে শহীদদের নাম লিপিবদ্ধ করতে সহায়তা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোন কাজ হয়নি। বধ্যভূমি সংরক্ষণে কেউ এগিয়ে আসেনি। আতাইকুলা বধ্যভূমি তথা গণকবরটি পড়ে আছে অযতœ আর অবহেলায়। সাধন পাল জানান, পাক হানাদাররা তার বাবা, কাকা ও জ্যাঠাসহ তাকে একইভাবে গুলি করে হত্যার উদ্দেশ্যে। সকলে মারা গেলেও গুলিবিদ্ধ হয়ে কোন রকমে বেঁচে যান তিনি। তার গলার শ্বাসনালি ছিঁড়ে যায়, তলপেটের চামড়া ছিঁড়ে যায় এবং হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়। হানাদার বাহিনী চলে গেলে লাশের সারির মধ্য থেকে ওই অবস্থায় কোন রকম পাশের বাড়ির ঘরের এক কোণে লুকিয়ে থাকেন তিনি। পরে তিনি কোন খাদ্য বা পানি কোন কিছুই খেতে পারেন না। যা খান তাই বের হয়ে আসে। সবাইকে হারিয়ে ওই গ্রামের লোকজন নির্বাক হয়ে যান। তিন দিন লাশ পড়ে থাকার পর পাশের গ্রামের লোকজন কোন রকমে ঘটনাস্থলের পাশেই মাটি খুঁড়ে ৫২ জনের মৃতদেহ স্তুপাকারে মাটিতে পুঁতে রাখে। নিখিল পাল জানান, পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একইভাবে লাশের মধ্য থেকে তিনিও বেঁচে যান। আজও তাদের কোন ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। কোন রকমে হারিয়ে যাওয়া পাল স¤প্রদায়ের মাটির ব্যবসা করে বেঁচে আছেন তারা। বিধবা রেনু বালা, ফেন্তু বালা ও সবেজু বালা তাদের সেই দিনের করুণ কাহিনীর বর্ণনা দেন। তারা বলেন, স্বামীকে হারিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক দুখে কষ্টে, অন্যের বাড়িতে ঝির কাজ করে এখনও বেঁচে আছেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে তারা আরও বলেন, ঘটনার ৪৬ বছর পার হলেও এখনও কোন সরকার তাদের কোন সাহায্য সহায়তা করেনি। তাদের ভাগ্যে জোটেনি বিধবাভাতা বা বয়স্কভাতার কোন কার্ড। এলাকাবাসী ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, অবিলম্বে সরকারীভাবে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে একটি ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করা হোক।
×