ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ সৈয়দপুর হানাদার মুক্ত দিবস

প্রকাশিত: ২১:২৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

আজ সৈয়দপুর হানাদার মুক্ত দিবস

স্টাফ রির্পোটার,নীলফামারী॥ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় হলেও নীলফামারীর রেলওয়ের শহর সৈয়দপুর হানাদার মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। গোটা দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পরও অবাঙালীদের অবরুদ্ধতার কারণে সৈয়দপুরে কোনো মুক্তিযোদ্ধা প্রবেশ করতে পারেনি। এইদিনে নীলফামারী জেলার সীমান্ত এলাকা হিমকুমারী ক্যা¤প থেকে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে প্রবেশ করে সৈয়দপুর শহরে। সেই সাথে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে ঢুকে পড়ে শহরে কয়েক হাজার লোক। শহরের পৌরসভা ভবনে ও অস্থায়ী আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে উড়ানো হয় জাতীয় পতাকা । পাক হানাদার দিবসটি স্মরন করে রাখতে আগামীকাল রবিবার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, প্রজন্ম ৭১, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যৌথভাবে বিজয় র্যালী, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠাানের আয়োজন করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও সৈয়দপুরে কতজন শহীদ হয়েছেন এর কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে বিভিন্ন সূত্র মতে, এই সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজার হতে পারে। অনেকে বলেন সৈয়দপুরে ৪০ হাজার বিহারীর অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার যুদ্ধাপরাধী বলে স্বীকৃত। ১৯৭১ এর ১৩ জুন শহরের গোলাহাট এলাকায় নির্মমভাবে হত্যা করা ৪৪৭ জন নারী পুরুষকে। শহরের একমাত্র স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে ওই সময়ে অবাঙালীদের বসবাসের কারণে সেখানেই বিভিন্ন জায়গা হতে বাঙালীদের হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। অদ্যাবধি ওই স্থানটিকে চিহ্নিত করা হয়নি এবং নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিন্তম্ভ। গোলাহাটে স্থানীয় উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌদ্ধ নির্মান করা হলেও সৈয়দপুর স্টেডিয়াম গণহত্যার স্থানটি মুছে যাচ্ছে স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে। সৈয়দপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একরামুল হক জানান, ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ লড়াই শুরু হলেও সৈয়দপুরে শুরু হয় এর ৩ দিন আগে। সেদিন স্থানীয় সেনানিবাসের পাক সেনারাসহ তাদেরই দোসর অবাঙালীদের একটি অংশ ঝাপিয়ে পড়েছিল শহরের নিরীহ বাঙালীদের ওপর। শহরের সংখ্যালঘু বাঙালীরা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যায়। আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে। আর যারা পালাতে পারেননি তাদের অনেককেই হত্যা কিংবা বন্দী করা হয়। এই শহরের প্রথম শহীদ হন শহরের পাশ্ববর্তী চিরিবন্দর উপজেলার আলোকডিহি ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহতাব বেগ। তিনি শহরের আটকেপড়া বাঙালীদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয় ২৩ মার্চ ভোরে। সেই থেকে ২-৩ দিন ধরে চলে গ্রামবাসীদের সাথে পাক সেনা ও তাদের সহযোগী অবাঙালীদের লড়াই। বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক সেনারা ঢুকে পড়ে গ্রামগুলোতে। তারা একটির পর একটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ২৪ মার্চ তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) ডা. জিকরুল হক, ডা. শামসুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, ডা. আমিনুল হক. ডা. ইয়াকুব আলী ও তুলশীরাম আগরওয়ালাসহ অনেককে গ্রেফতার করে রাখা হয় স্থানীয় সেনানিবাসে। সেখানে ৩ সপ্তাহ ধরে নির্যাতন চালানো হয় তাদের উপর। অতপর ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে অবস্থিত নিসবতগঞ্জ বালারখাল নামক স্থানে তাদেরকে হত্যা করা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কমলা প্রসাদ জীবিতকালীন সময়ে জানিয়েছিলেন, ওই বধ্যভূমিতে সেদিন একসাথে হত্যা করা হয় প্রায় ৩০০ জনকে। এরা ছিলেন সবাই সৈয়দপুরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সৈয়দপুর শহরের প্রবেশ মুখগুলোর স্থানীয় অবাঙালীরা নাম রেখেছিল খরচা খাতা। অর্থ্যাৎ ১, ২ ও ৩ নম্বর গেট। প্রতিদিন কোনো গেটে কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল তখন তা লিপিবদ্ধ করা হতো। এদিকে যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়ে সৈয়দপুর শহর জল্লাদ খানায় পরিণত হয়েছিল। রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের বয়লার শপে জীবন্ত নিক্ষেপ করে প্রায় ৩০০ বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল সময়ে সৈয়দপুরে সবচেয়ে বেশি হত্যাকান্ড ঘটেছিল ১২ থেকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে। সে সময় তড়িঘড়ি করে সৈয়দপুর বিমানবন্দরটি তৈরি করতে পাক সেনারা স্থানীয় বন্দী বাঙালীদের মাটি ভরাট কাজে ব্যবহার করতো। এক্ষেত্রে কেউ আপত্তি করলে তার ভাগ্যে নেমে আসতো নির্মম নির্যাতন। বন্দী বাঙালীদের শ্রমে নির্মিত বিমানবন্দর ব্যবহার করে পাকিস্তানি হানাদাররা যুদ্ধ বিমান চালিয়ে বাঙালীদেরকেই হত্যা করে। বিমানবন্দর নির্মাণে বন্দী বাঙালীদের মধ্যে অন্যতম হলেন কাশেম আলী মল্লি¬ক, ফকর উদ্দিন, আব্দুস সাত্তার, আব্দুর রশিদ প্রমুখ। এরপর ১৩ জুন কৌশলে মাড়োয়ারীদের রেলস্টেশনে একত্রিত করে ৩ ভাগে ভাগ করেছিল। বৃদ্ধ-যুবকদের পৃথক করে নারীদের নিয়ে যাওয়া হয় শহরের গোলাহাট আস্তনা-ই-হক (আস্তানা হক বিল্ডিং নামে পরিচিত)। সেখানে আটক নারীদের পাক সেনা ও তাদের দোসররা গণধর্ষণ চালায়। স্বাধীনতার পর ধর্ষিতা সেই নারীদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
×