ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ

বিজয় দিবসের আগ মুহূর্তে আমরা হারালাম আরও এক বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাকে। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৫ ডিসেম্বর শুক্রবার ভোর সাড়ে তিনটায় চলে গেলেন চট্টগ্রামবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে। চট্টগ্রামের সঙ্গে সারাদেশও শোকে মুহ্যমান। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ বিনম্র শ্রদ্ধায় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে শেষ অর্ঘ্য জানিয়েছেন তার কর্মজীবনের মহিমান্বিত অধ্যায়কে স্মরণ করে। একইভাবে সাধারণ মানুষের ভালবাসায়ও অভিষিক্ত হয় তার অনন্তযাত্রা। স্মরণকালের ইতিহাসে শবযাত্রায় এমন দীর্ঘ বহর অকল্পনীয়। এ শুধু একজন আদর্শনিষ্ঠ নিবেদিত কর্মীর সুদীর্ঘ কর্ম জীবনের প্রাপ্তিই নয়, তার চেয়েও বেশি অতি সাধারণ মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে এই কর্মবীরের নিরন্তর জনসম্পৃক্ত হওয়ার মতো এক অভাবনীয় মঙ্গল বার্তাও। চট্টগ্রামের নগর পিতা হওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা এক অকুতভয় দেশপ্রেমিক। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো দুঃসাহসিক অভিযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক বলিষ্ঠতার প্রতি তার নিরবচ্ছিন্ন শ্রদ্ধা আর নিবেদন। বঙ্গবন্ধুকে দেশের অকৃত্রিম অভিভাবক হিসেবে বিবেচনায় এনে জীবনভর তাঁকে হৃদয় নিঃসৃত স্তুতিতে স্মরণ করেছেন, সেখানেই মূর্ত হয়ে আছে চট্টগ্রাম নগরপিতার চারিত্রীক নির্ভীকতা এবং আদর্শিকবোধ। ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের প্রতিনিয়ত সঙ্গ পাওয়া এই সংগ্রামী ব্যক্তি জীবনব্যাপী মানুষ আর মানবতাকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। রাজনীতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ থেকে নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষের দরজায়। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, আনন্দে-বিষাদে তার দরাজ হস্ত সব সময়ই মুক্ত থাকত সব মানুষের জন্য। ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে সময়ের অপরিহার্যতায় একপর্যায়ে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বেও উঠে আসতে তাকে পেছন ফেরে তাকাতে হয়নি। আর ’৭১-এর মুক্তি সংগ্রাম তো ছিল তার জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং স্মরণীয় অধ্যায়। দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, জনগণের প্রতি অপরিসীম দায়বদ্ধতা থেকে শুরু করে অধিকার আদায়ের সমস্ত লড়াইয়ে এই স্বাধীনচেতা ব্যক্তি নিজের কর্তব্য পালনে এতটুকু পিছপা হতেন না। চট্টগ্রাম নগরীর পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় নামার পূর্বেই তিনি হয়ে যান জনগণের কাতারে তাদের সংগ্রামের এক সাহসী সহযোদ্ধা। সে দায়ভার জীবনভর বহন করার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নিজেকে সমর্পণও করেন তিনি। নাম, যশ, খ্যাতি কিংবা অর্থবিত্তের প্রতি কোন আসক্তি তাকে প্রলুব্ধ করেছিল কিনা তা জানা যায়নি। তার অতি সাধারণ যাপিতজীবন তেমন কোন প্রমাণও দেয় না। এরশাদের আমলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তার দৃঢ় ভূমিকা ছিল সময়ের দাবি। অপরাজনীতি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অর্থনৈতিক নিপীড়ন সব মিলিয়ে পুরো দেশ এক অসহনীয় পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হয় সেই সময়। তার নির্ভীক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনমনীয় বোধ সর্বোপরি সুষ্ঠু এবং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে অবিস্মরণীয় ভূমিকা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করার মতো। দেশের হরেক রকম বেসামাল অবস্থায় সময়ের দাবি পূরণ করতে গিয়ে নিজেকে তিনি যেখানে দাঁড় করান তা ছিল তার যোগ্যতারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি প্রথম কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান বা প্রশাসনিক পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। সেই শুরু। দাপটের সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে আদর্শিক চেতনায় ভূলুণ্ঠিত করে বীরদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে তাকে মোটেও ভাবতে হয়নি। ২০০৫ সালের সেই অবিস্মরণীয় মেয়র নির্বাচন চট্টগ্রামে। প্রধান প্রতিপক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মীর নাছির। তার কিছু আগে নির্বাচন হয়ে গেল রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের। মিজানুর রহমান মিনু আর ফজলে হোসেন বাদশা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বিএনপি-জামায়াত জোট তখন ক্ষমতায়। নির্বাচনের ফলাফলে প্রায়ই জিতে যাচ্ছিলেন ফজলে হোসেন বাদশা। কিন্তু এক সময় সেই ফলাফল প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। ভোটাররা বিস্মিত এবং হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এক সময় মনে হতে থাকে ফলাফল প্রকাশে কোন বিঘন্ন ঘটানো হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। আচমকা নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলে মিজানুর রহমান মিনুকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনেও এই ধরনের ফলাফল কারচুপির আশঙ্কায় সাধারণ মানুষ চিন্তিত এবং অনেক বেশি আতঙ্কিত হয়। সর্বশেষ ফলাফলের জন্য দেড় লাখেরও অধিক শ্রমজীবী মানুষ সেদিন চট্টগ্রামের নির্বাচন কমিশনের অফিস ঘেরাও করে রাখে। ততদিনে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী রিক্সাচালক, ট্যাক্সিচালক এবং শ্রমিকদের নেতৃত্বের পাকাপোক্ত আসনে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন। তার প্রমাণ জনসম্মুক্ষে আসতে বেশি সময় লাগেনি। প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে মীর নাছিরকে হারিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের নগর পিতার আসনে রাজসিকভাবে অভিষিক্ত হন। নগরের সুউচ্চ আসনে বসেও তিনি তার প্রতিসময়ের একান্ত সহযোগী সাধারণ মানুষদের এক মুহূর্তের জন্যও দূরে সরিয়ে রাখেননি। এর প্রমাণ তিনি বহুবার দিয়েছেন। আনন্দ-উৎসবে, শোকে-তাপে, বিপদে-বিপর্যয়ে একাই ছুটে বেড়িয়েছেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কোন প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে সাধারণ বিবাহের আসরেও তার উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। চট্টগ্রামে এখনও প্রচলিত আছে, সদ্য প্রয়াত কোন মৃতের বাড়িতে গেলে তার অনন্ত গোসল মহিউদ্দিন নিজের হাতে করাতেন, কফিন পরিয়ে দিতেন এবং শেষ যাত্রায় সমস্ত কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেন। চট্টগ্রামের পাহাড় ধসের সেই বিপর্যয়েও মাঝরাতে নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়াই পাগলের মতো বিপজ্জনক স্থানে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। এই মহান কর্মযোদ্ধা সম্পর্কে আরও প্রবাদ আছে- তার আমলে সিটি কর্পোরেশনের স্কুল এবং কলেজের শিক্ষক নির্বাচনে তিনি নির্বাচকম-লী হিসেবে জ্ঞানী বিশেষজ্ঞদের ওপর সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করতেন, যাতে যোগ্যরাই পদের জন্য বিবেচিত হতে পারে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি আজ সারাবিশ্বে ন্যায়-অন্যায়বোধে প্রশ্নবিদ্ধ। সততা বনাম দুর্নীতির অপকৌশলের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাজনৈতিক নেতারাও এ দায় অবশ্যই এড়াতে পারেন না। ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাজনীতি, জবর-দখলের নির্মম পোষণ শুধু ব্যক্তিক স্খলনই নয়, পুরো সমাজ ব্যবস্থার অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার জন্যও দায়ী এবং তা কোনভাবে উপেক্ষা করা চলে না। সেই ষোড়শ শতাব্দীতে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ম্যাকিয়াভেলির অপ্রতিরোধ্য বাণী আজও অনধিগম্য ‘সব ক্ষমতাই মানুষকে বিকৃত করে, চরম ক্ষমতা মানুষকে চরমভাবে বিকৃত করে।’ এ মহান বার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে বলা যায়, এখান থেকে বের হওয়া আসলেই খুব কঠিন। রাজনীতি এবং দক্ষ হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে তাকে এমন অনেক কিছু করতে হয়েছে যা অভিপ্রেত ছিল না। প্রশ্নবিদ্ধও তিনি হয়েছেন বার বার। যে শৃঙ্খলে জড়ানো রাজনীতি এবং প্রশাসন, তা কঠোরভাবে উপেক্ষা না করলে অনেক সময় যথার্থ এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে আসা সহজ হয় না। ত্রুটি-বিচ্যুতি, ভাল-মন্দ সব কিছু নিয়েই যে কোন মানুষের জীবন-রাজনীতি-সংস্কৃতি কিংবা তার চেতনা। সব মিলিয়েই কোন মানুষকে মূল্যায়ন করা সঙ্গত এবং প্রাসঙ্গিক। তবে সদ্য প্রয়াত সাবেক নগর পিতা মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে একটা কথা জোর দিয়েই বলা যায় তিনি শুধু সাধারণ মানুষেরই নন দেশের যথার্থ মঙ্গল সাধনে একজন সাহসী সেনাও বটে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে জানা যায়, তাকে মন্ত্রিত্ব দেয়া হলেও তিনি কোনমতেই চট্টগ্রাম ছাড়তে রাজি হননি। এমনটাই বা কয়জন পারেন। দেশী-বিদেশী যে কোন চক্রান্তকে রুখে দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সুরক্ষায় তার যুগান্তকারী অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ্য। তার সময়ে বন্দরে প্রার্থী নিয়োগেও কোন ধরনের অনিয়ম কিংবা বিশৃঙ্খলতার প্রশ্রয় দেয়া হতো না। মানুষ যখন তার খ্যাতির শীর্ষ শিখরে উঠে যায় তাকে নামানোর চেষ্টাও করা হয় হরেক রকম অপবাদ দিয়ে। খ্যাতি-অখ্যাতি যমজ ভাইয়ের মতো একই সঙ্গে বিরাজ করে। তারপরও সব মিলিয়েই একজন মানুষের পরিপূর্ণ কর্মযোগ এবং জীবনাচরণ থেকেই তাকে তুলে আনা অনেক বেশি জরুরী এবং যৌক্তিক। এই মহান মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, দীর্ঘ ১৭ বছরের চট্টগ্রামের নগর অভিভাবক এবং আমৃত্যু আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত নেতা হিসেবে তার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা আর শেষ প্রণাম। সাধারণ মানুষের পাশে থাকা এই বরেণ্য নেতাকে আসলে কোনভাবেই ভুলে থাকা সম্ভব নয়। যেসব জনহিতকর কাজ তিনি করেছেন সেই জায়গায় তার লব্ধ আসন থাকবে চিরস্থায়ী। মরণ সেই শক্ত আসনকে শূন্য করতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জীবনের যাত্রা পথে যাত্রীদল চলে বিরাম বিরতিহীন কে বা মনে রাখে, তবুও তারই মাঝে ক্ষণিক দাঁড়ায়ে স্মৃতির ফলকে যারা পদচিহ্ন রাখে, তারা মনে থাকে। লেখক : সাংবাদিক
×