ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রসিক নির্বাচন

তিন দলের মেয়র প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

তিন দলের মেয়র প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ১৭ ডিসেম্বর ॥ রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে যাচ্ছেন। এছাড়া একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগারও করছেন তারা। তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফা প্রত্যাশা করছেন প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে। বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগকালে তিনি তার এ প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ও বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী কাওসার জামান বাবলার বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগকালে ও পথসভায় মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ও কাওসার জামান বাবলার বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘লাঙ্গল ও ধানের শীষের প্রার্থী আমার বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানোর গুজব ছড়াচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার টাকাই নেই। কালো টাকা কিভাবে ছড়াবো। যারা অভিযোগ করছে তারাই কালো টাকা ছড়িয়ে ভোট নেয়ার চেষ্টা করছে।’ লাঙ্গল প্রতীকের পক্ষে একজন প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করে কৌশলে লাঙ্গলের প্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। ঝন্টু বলেন, আমাকে টাকা দিয়ে ভোট কেনার প্রয়োজন হবে না। আমি গত মেয়াদে রংপুরের যত উন্নয়ন কাজ করেছি সেটা বিবেচনা করেই মানুষ আমাকে ভোট দেবে। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার প্রতিনিধি হিসেবে আমি নির্বাচন করছি। কাজেই উন্নয়ন চাইলে নৌকাকে বিজয়ী করে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করবে রংপুরের মানুষ। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, মোস্তফার পক্ষে লাঙ্গলের গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এই গণজোয়ারকে কেউ রুখতে পারবে না। রবিবার দুপুরে রংপুর মহানগরীর ধাপ মেডিক্যাল মোড় এলাকায় রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার পক্ষে নির্বাচনী গণসংযোগের সময় তিনি একথা বলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মহানগর জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি এসএম ইয়াসির, যুগ্ম সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক, মহানগর ছাত্র সমাজের সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন সুমন প্রমুখ। জিএম কাদের বলেন, ‘রংপুরের মানুষের ভালবাসা জাতীয় পার্টিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জাতীয় পার্টি আপনাদের ঋণ কখনই পরিশোধ করতে পারবে না। মোস্তফাকে মেয়র নির্বাচিত করার মাধ্যমে রংপুরের পরিকল্পিত উন্নয়ন করে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চায় জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে জিএম কাদের শনিবার সন্ধ্যায় রংপুর আসেন। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত রংপুরে জাপা প্রার্থী মোস্তফার পক্ষে প্রচারে অংশ নেবেন তিনি। এদিকে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে কি-না তা নিয়ে সংশয়ে আছে বিএনপি। তাদের অভিযোগ, রসিক নির্বাচনে এখনও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। নির্বাচন কমিশন তাদের সঙ্গে বিমাতা সুলভ আচরণ করছে। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কা থাকলেও বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকতে চায় বলে জানিয়েছেন দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ইকবাল হাসান টুকু। তিনি বলেন, ‘আমরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকতে চাই। নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেখতে চাই সরকার আসলে কী করে। তারা নির্বাচনে কারচুপি করে কিনা।’ রবিবার দুপুরে শহরের গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা ইকবাল হাসান টুকু। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনও হয়নি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের কিছুই বলছে না, অথচ বিএনপির প্রার্থী হোটেলে বসে চা পান করলেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হচ্ছে।’ ইকবাল হাসান টুকুর দাবি, আওয়ামী লীগ একক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সে সুযোগ দেয়া হবে না। তার অভিযোগ, ‘রংপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিক তা সরকার প্রথম থেকে চায়নি। তারপরও আমরা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের পক্ষ থেকে কাওছার জামান বাবলাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু তাকে ঋণখেলাপী বলে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। হাইকোর্ট তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। তারপরও সরকার থেমে থাকেনি। তারা হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে সোনালী ব্যাংককে দিয়ে আপীল করায়; কিন্তু সেখানেও তারা হেরে যায়।’ পরে বাধ্য হয়ে বিএনপি মেয়র প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেয়। তিনি বলেন, সরকারদলীয় প্রার্থীরা আচরণবিধি ভঙ্গ করে প্রচার চালালেও সেদিকে খেয়াল না করে বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছে প্রশাসন। কোথাও সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। পথে পথে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে যা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নয়। বিএনপি রসিক নির্বাচনে একজন জনপ্রিয় ও যোগ্য ব্যক্তিকে সিলেকশন দেয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। টুকু অভিযোগ করেন, ‘বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে যাতে কোন পোলিং এজেন্ট না থাকে সেজন্য তারা বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে আমাদের পোলিং এজেন্টদের বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে, হুমকি দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের লোকজন বলছে, ‘ভোট পেলেও নৌকা জয়ী হবে, আবার ভোট না পেলেও নৌকাই জয়ী হবে।’ এছাড়া বিএনপির নেতাকর্মীরা ভোট কেন্দ্রে থাকলে পরিণতি খারাপ হবে এমন হুমকি দেয়ার অভিযোগও তোলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এর পরও আমরা নির্বাচন করতে চাই। সামনে আরও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আছে, সরকার কী করে আমরা তা দেখতে চাই। তারা যদি কারচুপি করে, তাহলে দেশের জনগণ তাদের মুখোশ খুলে দেবে।’ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে প্রচার ততই জমে উঠছে। ঝিমিয়ে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রার্থীর প্রচারে সরব হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের রংপুর আগমনে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে নির্বাচনের প্রচারে যুক্ত হবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফখরুল আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিএনপির মিডিয়া প্রেস উইং শায়রুল কবির খান। তিনি জানান, বিএনপি মহাসচিবের রবিবার রংপুর আসার কথা থাকলেও রবিবার ঢাকায় বিজয় র‌্যালি থাকায় সোমবার সকালে রংপুর অবস্থান করবেন তিনি। মেয়র প্রার্থী প্রতীক পাওয়ার পর মাঠপর্যায়ে তেমন কোন প্রচার না থাকায় রংপুরবাসী ধরে নিয়েছিল মাঠে বিএনপির অস্তিত্ব নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের আগমনে নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মাঠে ঘাঠে প্রতি ওয়ার্ডে চষে বেড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের সঙ্গে কর্মীরাও নেমে পড়েছেন ভোট যুদ্ধে। আওয়ামী মনোনীত প্রার্থী ঝন্টুর সমর্থনে জেলা ও মহানগর যুবলীগের কর্মী সমাবেশ ॥ রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার বিশ্ব শান্তির দর্শন জনগণের ক্ষমতায়ন সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর সমর্থনে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ রংপুর জেলা ও মহানগর শাখার প্রতিনিধি সভা রবিবার দুপুরে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুখ চৌধুরী। রংপুর মহানগর আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক এবিএম সিরাজুম মনির বাসারের সভাপতিত্বে রংপুর জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এইচ এম রাশেদুন্নবী জুয়েলের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্য উপস্থিত ছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মমতাজ উদ্দীন আহমেদ, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক লক্ষীন চন্দ্র দাস, যুগ্ম আহ্বায়ক নোশাদ আলম রাজুসহ প্রমুখ। বক্তারা বলেন, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে জনগণের ক্ষমতায়ন অব্যাহত রাখতে যুবলীগ চেয়ারম্যান দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনে প্রার্থীদের আচরণ বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘লিখিতভাবে আমাদের কাছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ কেউ করেনি। তারপরও আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হচ্ছে কিনা তা কঠোর পর্যবেক্ষণের মধ্যে রেখেছি আমরা।’ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আমরা সচেষ্ট আছি। তিনি বলেন, রবিবার সব প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসারসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। ওসির ফোন নম্বর ক্লোন করে প্রার্থীদের থেকে অর্থ আদায় ॥ রসিক নির্বাচনকে ঘিরে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সরকারী মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন করে বিভিন্ন প্রার্থীকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। তার মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন করে একদল প্রতারক চক্র এ কাজ করছে বলে অভিযোগ করেছেন খোদ ওসি বাবুল মিয়া। তিনি এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় দুটি জিডি দায়ের করেছেন এবং ফেসবুকের মাধ্যমে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছেন। এসব তথ্য নিশ্চিত করে বাবুল মিয়া জানান, কোতোয়ালি থানার ওসির সরকারী মোবাইল ফোন ০১৭১৩-৩৭৩৮৭৪ নম্বরটি দিয়ে রসিক নির্বাচনের বিভিন্ন প্রার্থীর কাছে ফোন দিয়ে অবৈধ অর্থ চেয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। বিষয়টি তাকে নির্বাচন কমিশনের রংপুর আঞ্চলিক কর্মকর্তার দফতর থেকে জানানো হয়। এমন তথ্য পেয়ে তিনি তাৎক্ষণিক বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামেন। তিনি জানতে পারেন তার সরকারী নম্বরটি ক্লোন করা হয়েছে।
×