ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লাল-সবুজের পতাকাতলে ছায়ানটের নিবেদন

এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি...

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি...

মোরসালিন মিজান ॥ বাইরে বহু মানুষ। সবাই এলোমেলো পথ হাঁটছেন। গন্তব্যহীন। হৈ হুল্লোড়ের শব্দ আসছে অনেক দূর থেকে। কেউ কেউ চলন্ত ট্রাকের ওপর যেমন খুশি নাচছেন। গান হচ্ছে বিকট শব্দে। আর ভেতরে? আহা, কী শান্ত শীতল পরিবেশ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর ঘেরা খেলার মাঠে লাল সবুজের মঞ্চ। সেখানেও নাচ গান হচ্ছিল বটে। তবে সবকটি পরিবেশনাই অনবদ্য। শুদ্ধ সুরে চমৎকার গাওয়া। অনন্য সাধারণ কোরিওগ্রাফি। আর যে কথাটি না বললেই নয়, সেটি হচ্ছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। বিভিন্ন পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে সবাই মিলে স্লোগান দিয়েছেন। বাঙালীর জয়। বাঙালিত্বের জয় ঘোষণা করেছেন। সচেতন প্রয়াসের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়েছিলেন উপস্থিত সকলে। দর্শক শ্রোতারা ছিলেন সুশৃঙ্খল। লাল সবুজে সুন্দর সেজে এসেছিলেন। উৎসবের অংশ হয়েছিলেন তারা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি ছায়ানটের আয়োজন। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের এই বাতিঘর কয়েক বছর ধরে খোলা মাঠে উদযাপন করছে বিজয় দিবস। ধানম-ি এলাকায় নিজস্ব ভবন। সেই ভবন ছেড়ে সবাই চলে আসছেন খোলা আকাশের নিচে। এভাবে জনগণের আরও কাছে যাওয়ার প্রয়াস। বাঙালিত্বের চেতনায় সবাইকে একাত্ম করার স্বপ্ন। ফলে আয়োজনটি বিজয় দিবসের প্রচলিত উদযাপনগুলো থেকে সহজেই আলাদা হয়ে যায়। কোন অস্থিরতা বা হূলস্থূল নেই। স্থ’ূলতা নেই। খেলার মাঠ গ্যালারিজুড়ে ভাবগাম্ভীর্য়পূর্ণ পরিবেশ। তাই বলে বিজয়ের আনন্দে ভাটা পরেনি একদম। বরং বাঙালীর সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, দেশমাতার প্রতি প্রেমের অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ ঘটানো হয় উন্মুক্ত মঞ্চ থেকে। এবারও মাঠের একাংশ ঘিরে নিয়ে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। ভূমিভাগ থেকে বেশ উপরে গোলাকার লাল মঞ্চ। দেখেই বোঝা হয়ে যায় পতাকার লাল। আর মঞ্চের চারপাশে সবুজ পোশাক পরে বসেছিলেন ছায়ানটের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। উৎসব উপভোগ করেত অসা সাধারণ মানুষও সবুজ শাড়ি পাঞ্জাবি ফতুয়া পরে মেঝেতে বসেছিলেন। এভাবে লাল সবুজের বিশাল মানব পতাকাটি দৃশ্যমান হয়। মঞ্চের চারপাশে ছিলেন ৩ হাজারের মতো মানুষ। সংলগ্ন গ্যালারিতে বসেছিলেন প্রায় ২ হাজার। সব মিলিয়ে ৫ হাজার মানুষের উপস্থিতি! অধিকাংশ উৎসব অনুষ্ঠানের শুরু মানেই, দেরি করে শুরু। ছায়ানটের বেলায় সে সুযোগ নেই। ঠিক পৌনে ৪টায় মঞ্চে এসে দাঁড়ান সন্জীদা খাতুন। অহর্নিশ সংগ্রামী মানুষটি এখনও ক্ষ্যান্ত দেননি। ভরপুর প্রাণ নিয়ে সকলের সামনে হাজির হন। ছায়ানট সভাপতি আয়োজনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাজী জাহেদুল হাসান। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ৫ হাজারের মতো মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যান। সন্জীদা খাতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় শিল্পীদের সঙ্গে তিনিও গানÑ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...। শিল্পীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলান হাজার হাজার মানুষ। দেখতে দেখতে আবেগঘন হয়ে ওঠে পরিবেশ। প্রাণ থেকে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নয় শুধু, যাদের জন্য বাংলাদেশ পাওয়া সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি, শহীদ আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এর পর মূল অনুষ্ঠান। মঞ্চের লাল রং অক্ষুণœ রাখতে শিল্পীরাও লাল পোশাক পরে মঞ্চে ওঠেন। প্রথমেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে সম্মেলক গান। ‘ভায়ের মায়ের এত ¯েœহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?/Ñওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি/আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।’ বিখ্যাত গানের সঙ্গে চমৎকার নৃত্য পরিবেশন করেন একদল শিল্পী। শহীদের রক্তে ভেজা মাটিতেই শেষ আশ্রয় নেয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়ে শেষ হয় প্রথম পরিবেশনা। পরের নৃত্যগীতেও দেশবন্দনা। এবার বিদ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল থেকে শিল্পীরা গায়Ñ এই মাটি এই কাদা মেখে/এই দেশেরই আচার দেখে/সভ্য হ’লো নিখিল ভুবন দিব্য পরিপাটি/ খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি/আমার দেশের মাটি...। গানের সঙ্গে যে কোরিওগ্রাফি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন শ্রোতা দর্শক। অনুষ্ঠানে যুগল কণ্ঠে গাওয়া হয় ‘এই বাংলার মাটিতে/মাগো জন্ম আমায় দিও/এই আকাশ নদী পাহাড়/আমার বড় প্রিয়...। জয়দেব সেনের বিখ্যাত গানে বাঙালীর অনুরাগের কথা জানান ফারহানা আক্তার ও বিজনচন্দ্র মিস্ত্রী। দুজনই ছায়ানটের শিক্ষক। এত বড় মঞ্চে মাত্র দুজন। তাতে কী? ছল ছল চোখে কতজন যে গাইলেন তাদের সঙ্গে, সত্যি দেখার মতো দৃশ্য! কবিতায়ও বলা হয় কিছু কথা। দীর্ঘকাল পর একক আবৃত্তি নিয়ে মঞ্চে আসেন সৈয়দ হাসান ইমাম। ছায়ানটেরই মানুষ তিনি। সমকাল নিরীক্ষা করেই হয়ত তিনি বেছে নেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কালজয়ী কবিতা। আবৃত্তির ভাষায় জানতে চানÑ এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়? আবৃত্তির পর আবারও নৃত্যগীত। ‘ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে’ গানটি নাচেরে মুদ্রায় তুলে ধরেন শিল্পীরা। বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনা মার খাচ্ছে এখন। সেই আক্ষেপের কথা শিল্পীরা জানান শাহ আবদুল করিমের গান থেকে। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানের সঙ্গে ছিল দলীয় নাচ। একক কণ্ঠে গান করেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী লাইসা আহমদ লিসা। ‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক’ গানে যে আকুতি, সত্যি ভীষণ নাড়া দিয়েছে ভেতরে। আয়োজনের শেষাংশে ছিল ৫টি নৃত্যগীত। পরপর। ‘সংকোচের বিহ্বলতা’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘নাও ছাড়িয়া দে’, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’, ‘লাখো শহীদের রক্তমাখা’ গানগুলোর সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পীরা। অনুষ্ঠান শেষও করা হয় জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে। সকলে মিলে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে গাইতে বিদায়। সত্যি সুন্দর। অনন্য।
×