ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মন্ত্রী ছায়েদুল হকের ইন্তেকাল

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মন্ত্রী ছায়েদুল হকের ইন্তেকাল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মুহাম্মদ ছায়েদুল হক আর নেই। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার সকালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। ছায়েদুল হকের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে গেছেন। তার ছেলে রায়হানুল হক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রভাষক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছায়েদুল হক ছিলেন দেশের একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে পাঁচ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ছায়েদুল হক। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এই প্রবীণ নেতা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বার্তায় জানানো হয়েছে, প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন মন্ত্রী ছায়েদুল হক। শনিবার সকাল সাড়ে আটটায় তার মৃত্যু হয়। বিএসএমএমইউর পরিচালক আবদুল্লাহ আল হারুন বলেন, গত অক্টোবর থেকে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন মন্ত্রী ছায়েদুল হক। একদিন আগেই হাসপাতালে গিয়ে তাকে দেখে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ ছায়েদুল হকের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, তার মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করল। দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। রাষ্ট্রপতি প্রয়াত ছায়েদুল হকের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। নিজের মন্ত্রিসভার সদস্য ছায়েদুল হকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার পাঠানো এক শোক বার্তায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছায়েদুল হকের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ৬ দফার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি আরো বলেন, জনপ্রিয় এই নেতা আওয়ামী লীগের টিকেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে ১৯৭৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পাঁচ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন নিবেদিত প্রাণ ও সৎ নেতাকে হারাল। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। মৎস্য ও প্রণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবাল কল্যাণমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। শনিবার এক শোক বার্তায় তিনি মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জনিয়েছেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও খাদ্যমন্ত্রী কমরুল ইসলাম। শনিবার পাঠানো পৃথক শোক বার্তায় তারা মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা ॥ মৃত্যুর খবর পেয়ে সকালে বিএসএমএমইউতে যান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রয়াত নেতাকে ‘সৎ রাজনীতির প্রতিভূ’ অভিহিত করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। এদেশে অনেকে ‘পাওয়ার’ পেলে তার অপব্যবহার করে, কিন্তু ‘পাওয়ার’ পেয়েও তাকে দুর্নীতি স্পর্শ করতে পারেনি। তার মতো সৎ মানুষ বিরল। আজ জানাজা ও দাফন ॥ শনিবার বেলা এগারোটার দিকে ছায়েদুল হকের মরদেহ মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়ায় তার সরকারী বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে মরদেহ নেয়া হবে হাসপাতালের হিমঘরে। ওবায়দুল কাদের জানান, রবিবার সকাল সাড়ে আটটায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ছায়েদুল হকের মরদেহ নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী ও দলের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সেখানে প্রথম জানাজা হবে। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে মরদেহ। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হবে। চট্টগ্রামের প্রবীণ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর একদিনের ব্যবধানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বর্ষীয়ান নেতা ছায়েদুল হককে হারাল আওয়ামী লীগ। তিনি ১৯৪২ সালের ৪ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলাধীন পূর্বভাগ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা মরহুমা মেহের চান্দ বিবি ও পিতা মরহুম আলহাজ মোহাম্মদ সুন্দর আলী। তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়া তিনি আইন বিষয়ে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি দীর্ঘদিন আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ও বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের এ্যাডভোকেট হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৫ থেকে ৬৬ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি স্বাধীনতা-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতের ত্রিপুরায় অবস্থিত লেম্বুছড়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর একাধারে ৭ম থেকে ১০ম সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। সংসদীয় কাজে তার অভিজ্ঞতা ব্যাপক। ৭ম ও ৯ম সংসদে তিনি খাদ্য ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্য, অর্থ, সরকারী তহবিল ও বিশেষ বিষয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১০ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেন। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে নাসিরনগর ডিগ্রী কলেজ, চাতালপাড় ডিগ্রী কলেজ ও চাতালপাড় উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়নে অবদান রাখেন। তিনি সরকারী সফরে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, কুয়েত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ইতালি, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত ও এক পুত্র সন্তানের জনক।
×