ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

দেশের মানুষ যাতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে-এটাই হোক শপথ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

দেশের মানুষ যাতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে-এটাই হোক শপথ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ত্যাগের মহিমায় নিজেদেরকে গড়ে তোলার জন্য দেশের নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমরা বীরের জাতি, যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি। একথা কখনোই ভুললে চলবে না। আমরা বিজয়ী জাতি, কারোর কাছে মাথানত করে চলি না, চলব না। সারা বিশ্বের সামনে বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা সব সময় মাথা উঁচু করে চলব। দেশে যাতে আর কোন অন্যায়-অনিয়ম না হয়, বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে, যুগের পর যুগ এভাবেই বিজয়ের আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকতে পারে- বিজয়ের দিনে এই আমাদের প্রতিজ্ঞা। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে শনিবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বক্তৃতা প্রদান কালে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সবাইকে হত্যা করে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর পুরো রক্তকেই ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। দেশবাসী আমাদের দেশ সেবার সুযোগ দেয়ার কারণেই বাংলাদেশকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলছি। বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল। বাংলাদেশ আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, যে মর্যাদা ’৭৫-এ ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। সারা বিশ্ব এখন বাঙালীদের দিতে তাকিয়ে থাকে। আমাদের এই বিজয় সবাইকে ধরে রাখতে হবে। গণভবন থেকে এই ভিডিও কনফারেন্সে সূচনা বক্তব্যের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে থেকে কয়েকজনের সরাসরি প্রশ্নেরও উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য ও অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। গণভবনে এ সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রজন্মের কয়েক তরুণদের সঙ্গে জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে কণ্ঠমেলালে গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ওই স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পরে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যাগের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, এই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণের পথ ধরেই আমাদের এই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর একটিমাত্র ভাষণে দেশের প্রতিটি ঘর এক একটি দুর্গে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ বাঙালী জাতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করে। হাতে গোনা কয়েকটি রাজাকার-আলবদর ও পাকিস্তানের দোসর ছাড়া দেশের প্রতিটি মানুষ পাকিস্তানী শত্রুদের পরাজিত করে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বীর বাঙালীদের কাছে পাকিস্তানের ৯৬ হাজার সেনাবাহিনী আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চ পাক হানাদাররা গণহত্যা চালানোর পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শেষ শত্রু থাকা অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ অপরাধে পাক হানাদাররা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আন্তর্জাতিক চাপে এবং তাদের ৯৬ হাজার সৈন্যের প্রাণ বাঁচানোর কারণে পাক হানাদাররা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এই ঐতিহাসিক উদ্যানেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ কীভাবে পারিচালিত হবে তার নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আজ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা বিশ্বের ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্থান পাওয়ার কারণে সমগ্র বাঙালীর সম্মান অনেক উচ্চস্তরে পৌঁছে গেছে, বাঙালী জাতির কাছে এটি গৌরবেরও। প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, বিজয় দিবসের এই দিনে ঘৃণা ও ধিক্কার জানাই যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের দোসর হিসেবে আমাদের মা-বোনদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। ঘৃণা জানাই যারা রাজাকার-আলবদর-আলশামস হয়ে সারা দেশে গণহত্যা চালিয়েছে আমাদের পরাজিত করতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা পরাজিত হয়নিই, বরং বীর বাঙালীরা তাদেরই পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর পাক হানাদাররা আমাদের মা, বোন, ভাইসহ পরিবারের সবাইকে ধানম-ির ১৮ নম্বর বাড়িতে বন্দী করে রেখেছিল। ১৬ ডিসেম্বর যখন পাক হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে, বাইরে জয় বাংলার গগনবিদারী স্লোগান, তখনও আমরা ওই বাড়িতে বন্দী। বাইরে মানুষের স্লোগানের সঙ্গে আমরাও পাক হানাদারদের সামনেই বাড়ির ভেতর থেকে জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছি। দেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও আমরা মুক্তি পেয়েছি ১৭ ডিসেম্বর। ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। ২০২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। প্রশ্নোত্তর পর্বে নতুন প্রজন্মের এক তরুণের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিজয়োৎসবে কেমন লাগছে? এ সময় সমন্বরে সবাই বলেন, খুবই ভাল লাগছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই চিরদিন বাঙালী জাতি যেন এমনিভাবে বিজয়ের আনন্দ-উৎসব পালন করতে পারে। আর কোন অন্যায়-অনিয়ম যেন এ দেশে না হয়। বাংলাদেশের মানুষ যেন শান্তিতে থাকে। মেহেন্দীগঞ্জ থেকে আসা এক মুক্তিযোদ্ধার প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বিজয়ের এই দিনে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই লাখো সালাম। তরুণী মায়েশার প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তোমরা নতুন প্রজন্মরাই হচ্ছে আমাদের দেশের ভবিষ্যত। তোমাদের মধ্যে থেকেই আগামী দিনের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষক হবে। আগামী দিনে দেশকে গড়ে তুলতে তোমাদের সেভাবেই নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। আমরা তো আর বেশিদিন নেই। তোমাদেরই আগামী দিনে দেশের হাল ধরতে হবে, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তোমাদের মধ্যে থেকে উপযুক্ত নাগরিকের হাতেই আমরা দেশকে তুলে দিয়ে যেতে চাই।’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি ইয়াকুব আলীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশ্রিতদের আশ্রয় দেয়া আমাদের কর্তব্য। পবিত্র ইসলাম ধর্মেও আছে কেউ আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দিতে হবে। তবে আমি খুশি আজকের নতুন প্রজন্মরাও এটা অনুভব করতে পারছে। আমরা আশা করি, মিয়ানমার সরকার এদেশে আশ্রয় নেয়া তাদের নাগরিকদের দ্রুততম সময়ে ফেরত নেবে।
×