ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশীয় অর্থনীতিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অগ্রগতি - সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

দেশীয় অর্থনীতিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অগ্রগতি  - সুমন্ত গুপ্ত

সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারায় আজ আমরা অবস্থান করছি আধুনিক সভ্যতায়। পৃথিবীকে আমরা এখন চিনি উন্নত বিশ্ব নামে। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করার ফলে মানুষের জীবন এখন উন্নত। শিক্ষা অগ্রগতি এবং বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবনের ফলে আমরা এখন হাতের মুঠোয় সারা পৃথিবী তালুবন্দী করছি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে আমাদের বাংলাদেশও। বর্তমান সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি চেষ্টা করছে আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দিতে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০২১ প্রণয়ন করেছে। রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশে যে কয়কটি কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সারা ফেলেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মোবাইল ব্যাংকিং। এটি বাংলাদেশে একটি যুগান্তকারী ব্যবস্থা এবং যার কারণে আমাদের আর্থিক কার্যক্রম অনেক বেশি সচলায়তন হয়েছে।এ দেশের কোটি কোটি মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি উদ্যোগ ছিল যেন এ দেশের সব মানুষ ব্যাংকিং সেবার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। এটি বাস্তবায়ন করার জন্য তারা দেশের মোবাইল অপারেটরদের সেবাকে কাজে লাগায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। এখন দেশের কোটি কোটি মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা গ্রহণ করছে। এর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ব্যাপক অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেছি। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনার কথা যখন আমরা ভাবি, তখন আমরা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির সেবার কথা ভাবি। মোবাইল আর্থিক সেবার চারটি পর্ব আছে। প্রথমটি হলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির কাছে টাকা পাঠানো। দ্বিতীয়টি মোবাইল ইন্স্যুরেন্স, মোবাইল ক্রেডিট ও মোবাইল সেভিং। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির কাছে টাকা পাঠানো ছাড়া অন্য সেবাগুলোর ব্যবহার বাংলাদেশে নেই। কিন্তু ভোক্তা, উৎপাদনকারী, ক্রেতা, বিক্রেতা, নাগরিক, সরকারী প্রতিষ্ঠানÑ এমন অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল আর্থিক সেবা ফলপ্রসূ হতে পারে। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশের বেশি এজেন্টভিত্তিক লেনদেন হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান প্রথম। উন্নত বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ২০১১ সালে আমাদের এ সেবা চালু হয়। তখন উদ্দেশ্য ছিল আন্য ব্যাংক (যারা ব্যাংকিং কার্যক্রম করে না) মানুষকে কীভাবে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যায়। কিন্তু আজ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এত সম্প্রসারিত হয়েছে যে আন্য ব্যাংক ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় যারা আছে, সবাই এ সেবা গ্রহণ করছে। মোবাইল ব্যাংকিং এখন একটি ব্যাপক জনপ্রিয় মাধ্যম। এর মাধ্যমে টাকা জমা করা যায়, ওঠানো যায়, বিভিন্ন প্রকার সেবার বিল পরিশোধ করা যায়। টেলিফোন ও মোবাইল অপারেটরদের বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এ সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। দেশে মোবাইল ব্যাংকিং দ্রুত টাকা প্রাপ্তি ও পাঠানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তবে প্রযুক্তিনির্ভর এ লেনদেনের কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসে ও জঙ্গী কার্যক্রমে অর্থায়ন, মানবপাচার ও মাদক ব্যবসায়ীদের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্র্রীয় বাংক ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে এসবের প্রমাণও পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রবাহ কমার অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাংক কর্মকর্তারা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারে হু-ি হওয়ার অভিযোগ করেন। এতে করে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় লেনদেনের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে হু-ি হ্রাসের চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অপব্যবহার করে হু-ি পথে রেমিটেন্স এনে সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছে দেয়া, জঙ্গী ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুষ লেনদেনসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। একটি এ্যাকাউন্টে ৩ লাখ টাকার বেশি জমা রাখা যাবে না। এর আগে এ্যাকাউন্ট খোলা ও লেনদেন সংক্রান্ত বেশ কিছু কঠোরতা আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের অপ্যবহার রোধ এবং সুশৃঙ্খল ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আগামী ১ জানুয়ারির হতে একজন গ্রাহকের গ্রাহক তার ব্যক্তি মোবাইল হিসাবে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা রাখতে পারবেন। যে সকল ব্যক্তি মোবাইল হিসাবে ৩ লাখ টাকার অধিক স্থিতি রয়েছে, সে সকল হিসাবের স্থিতি আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে উপর্যুক্ত সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে হিসাবধারীর হিসাবের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যাংক হিসাবে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি জারি করা সার্কুলারে মাধ্যমে বলা হয়, একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহারে একটি মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে একটি মাত্র এ্যাকাউন্ট চালু রাখা যাবে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১৫ হাজার এবং মাসে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জমা (ক্যাশ ইন) করা যাবে। এছাড়া প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা এবং মাসে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন (ক্যাশ আউট) করা যাবে। আগে প্রতিদিন ২৫ হাজার এবং মাসে দেড় লাখ টাকা ক্যাশইন ও ক্যাশ আউট করা যেত। ওই সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, দিনে সর্বোচ্চ ২ বার ক্যাশ ইন করা যাবে, আগে ক্যাশ ইন করা যেত ৫ বার। তবে মাসিক ক্যাশ ইন সংখ্যা ২০ বার অপরিবর্তিত রাখা হয়। এছাড়া ক্যাশ আউটের সংখ্যা ৩ বার থেকে কমিয়ে দিনে ২ বার এবং মাসে ১০ বার অপরিবর্তিত রাখা হয়। এছাড়া টাকা ক্যাশইন করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫ হাজার টাকার বেশি ক্যাশ আউট করা যাবে না। কোন মোবাইল হিসাবে ৫ হাজার টাকার বেশি ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউট করতে হলে গ্রাহককে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হবে এবং এজেন্ট ওই পরিচয়পত্রের নম্বর রেজিস্টার খাতায় লিখে রাখবেন। ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউটের আলাদা রেজিস্টার খাতায় গ্রাহকের স্বাক্ষর বা টিপসহি রাখতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ২০১০ সালে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ১৮টি ব্যাংকের লাইসেন্স রয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট সংখ্যা ৭ লাখ ৭৩ হাজার ২৮৩ জন। নিবন্ধনকৃত ৫ কোটি ৭৭ লাখ এ্যাকাউন্টের মধ্যে ৩ কোটি এ্যাকাউন্ট সচল রয়েছে। সেপ্টেম্বরে দৈনিক গড়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ৭১৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
×