ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশে রফতানি হচ্ছে বগুড়ার মরিচ

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

বিদেশে রফতানি হচ্ছে বগুড়ার মরিচ

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার মরিচ। বগুড়ার মরিচের ঝালের কথা কার না জানা। স্থানীয় কথায় ‘পত্ত্যে’। বগুড়ার সবুজ কাঁচা মরিচ আর শুকনো লাল মরিচের ঝালের কদর এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। সবুজ এই মরিচ পেকে লাল না হতেই প্যাকেটজাত হয়ে উড়োজাহাজের ফ্রেইটে উঠে গন্তব্য- মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া। বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় বড় আসন করে নিয়েছে। এই মরিচ বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি দেয়ায় চাষীদের মুখে ফুটেছে হাসি। একের দেখাদেখি আরেক চাষী মরিচের আবাদ শুরু করেছে। দিনে দিনে বগুড়ার মরিচের ঝালের চোটে কৃষকও লাল হয়ে যাচ্ছে। রফতানি শুরু হওয়ায় থার্ড পার্টি বিজনেস (ফড়িয়া দালাল) জেঁকে বসেছে। বগুড়ার মরিচের ঝাল ও তেজের একটি গল্প আছে। পঞ্চাশের দশকের শেষে কলাকোপা এলাকার একজন গৃহস্থ মরিচের আবাদ করে লাভবান হয়ে তৎকালীন সরকারের কাছে হেলিকপ্টার কিনতে গিয়েছিলেন। সরকার বলেছিলেন, দেশে যদি কখনও কোন ব্যক্তিকে হেলিকপ্টার কেনার অনুমতি দেয়া হয় তিনিই প্রথম পাবেন। সেই গৃহস্থ আর নেই। এই গল্প আজও প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের মুখে মুখে ফেরে। বগুড়ার মরিচের ঝাল কেমন এরও অনেক উদাহারণ আছে। চট্টগ্রামের কয়েকজন মহাস্থানগড় দেখে ফেরার পথে বগুড়ার হোটেলে খাওয়ার সময় ৪/৫টি করে মরিচ চাইলেন। হোটেলওয়ালা বললেন এত মরিচ খেতে পারবেন না। উত্তর ছিল ১০/১২টি করে মরিচ খান তারা। একটি কাঁচা মরিচের পুরোটি একবারে কামড়ে মুখে নেয়ার পরই বুঝেছিলেন বগুড়ার মরিচের ঝাল কেমন! বহু বছর পর এই মরিচ বগুড়ার চাষীদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিচ্ছে। ঢাকার একাধিক রফতানিকারক এখন বগুড়ার মাঠে। বগুড়ার গাবতলী সারিয়াকান্দি সোনাতলা ধুনট এলাকার কৃষক সকালে উঠেই যাচ্ছে মরিচের ক্ষেতে। তারও আগে পাইকার এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্রেতারা ট্রাক নিয়ে হাজির হচ্ছে। একদিকে মরিচ তোলা হচ্ছে, আরেকদিকে কার্টনে ভরে প্যাকেটজাত করে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। ঢাকার এক রফতানিকারক জানালেন, বছর দুয়েক আগেও বিদেশ বিভূঁইয়ে ভারতের কাঁচা মরিচের কদর ছিল। ভারত রফতানি কমিয়ে দেয়ায় বাংলাদেশের মরিচ যেই না প্রবেশ করেছে অমনি বাজিমাত। বিদেশীদের কাছে বগুড়ার মরিচের চাহিদা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। তারা এখন মরিচ দেখলেই বলে এগুলো বগুড়া বাংলাদেশের মরিচ কি না! কার্টনে ইংরেজিতে ‘গ্রীন চিলিজ অব বগুড়া বাংলাদেশ’ লিখে দেয়া হয়। চাহিদা যে হারে বাড়ছে সেই তুলনায় আবাদ ও উৎপাদন এখনও কম। তবে কৃষক আশাবাদী এই ভেবে যে এই চাহিদা অব্যাহত থেকে ধরে রাখা গেলে মরিচের আবাদ বেশি করবে। বগুড়া কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব- এ বছর বগুড়ার ১২ উপজেলায় প্রায় দশ হাজার হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। বেশি আবাদ হয়েছে সারিয়াকান্দি, গাবতলী, ধুনট, শিবগঞ্জ ও সোনাতলায়। মোট উৎপাদিত ৪০ হাজার মেট্রিক টন মরিচের মধ্যে দিনে দিনে রফতানির পাইপ লাইনে যোগ হচ্ছে। একাংশ বিদেশেও গেছে। এই অবস্থা কৃষকের কাছে একটি সুখের বার্তা দিয়েছে এভাবে মরিচ চাষ করে আর পিছনে তাকাতে হবে না। বগুড়ার গাবতলীর জলশুকা, নারিল্যা, সুবোদ, কলাকোপা এলাকায় দেখা যায় মরিচ রফতানির অন্তত দশটি কোম্পানি খুঁটি গেঁড়ে বসেছে। কখনও সরাসরি জমি থেকে কিনে নিচ্ছে। কখনও যাচ্ছে আড়তে। নারিল্যার কৃষক তারাজুল ইসলাম বললেন, তিনি এক একর জমিতে মরিচের চাষ করেছিলেন। এক দিনেই জমি থেকে ১শ মন কাঁচা মরিচ বিক্রি করে এক লাখ টাকা পেয়েছেন। আশা করছেন চলতি মৌসুমে ৪ লাখ টাকার মরিচ বেচতে পারবেন। মৌসুমে মরিচের দর বেশি। বর্তমানে বিক্রি প্রতিমণ (৪০ কেজিতে এক মণ হিসাবে) ৪ হাজার টাকা থেকে ৪২শ টাকা কেজি দরে। এই সবুজ মরিচের পাশাপাশি শুকনো লাল মরিচ কেনার সেন্টারগুলো এবার একটু অসুবিধায় পড়েছে। প্রতিবার যে পরিমাণ শুকনো মরিচ কিনে তারা গুড়া মশলা বানায় এবার তার ব্যত্যয় ঘটতে পারে। কারণ কাঁচা মরিচই এখন রফতানি তালিকায়। মরিচের আড়তদার ও পাইকাররা বলছেন বিদেশ কাঁচা মরিচ রফতানি শুরু হওয়ায় চাহিদা ও দাম দুই-ই বেড়েছে। আরেকদিকে মরিচ প্যাকেটজাত করার শ্রমিকরা কাজ পেয়েছে। প্রতিটি কার্টনে ৫ কেজি করে ভরানো হচ্ছে। বিশেষ ব্যবস্থায় ভরানোতে মরিচ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। একজন রফতানিকারক বললেন, তারা ভাবতেই পারে নি বিদেশে বগুড়ার মরিচের কদর রাতারাতি এতটা বেড়ে যাবে। রান্নায় ঝালের জন্য বগুড়ার মরিচ কম লাগে বলে অধিক পছন্দ। আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় “এ্যার নাম বগ্র‌্যার পত্ত্যে..”।
×