ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চৌধুরী শহীদ কাদের

মুক্তিযুদ্ধে বরাক উপত্যকার কবিতা ও কবিগান

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধে বরাক উপত্যকার কবিতা ও কবিগান

বরাক উপত্যকা একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাক স্বাধীনতা যুগের ‘সুরমা উপত্যকা’র খ-িত পূর্বাংশ অর্থাৎ বর্তমান দক্ষিণ আসামের তিনটি জেলা (কাছাড়, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ)-এর সাধারণ অভিধা ‘বরাক উপত্যকা’। উত্তর ভারতের সীমান্তবর্তী এই রাজ্যটি একাত্তরে পালন করেছিল এক অনন্য ভূমিকা। একদিকে তারা দিয়েছিল বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয়, ত্রাণ ও সহমর্মিতা, মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিল প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র। অন্যদিকে এই উপত্যকার সাধারণ মানুষজন গানে-কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে একাত্তরে সহমর্মিতার এক অনবদ্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা জনযুদ্ধ বলি, একাত্তরে এই উপত্যকায় সেই জনযুদ্ধের প্রকৃত রূপ দেখা গিয়েছিল। সাধারণ জনগণ একদিকে শরণার্থীদের আশ্রয় ও সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিল, পাশাপাশি তাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছেন, লিখেছেন কবিতা ও কবিগান। প্রায় ১৫ জন কবির পঞ্চাশটি কবিতা ও কবিগান একাত্তরে এই উপত্যকার জনমানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, বদরপুর, শিলচরের হাটে বাজারে এই সব কবিরা তাদের রচিত কবিতা ও কবিগানে মুখরিত করেছিল একাত্তরের বরাক উপত্যকার জনজীবন। এসব কবিতা ও কবিগান উপত্যকার সাধারণ মানষকে ভীষণ প্রভাবিত করেছিল। কবিতা ও কবিগানে উঠে আসা সংগ্রামী বাঙালীর দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনায় কাতর হয়ে সাধারণ মানুষ একাত্ম হয়েছিল একাত্তরে। অন্যদিকে আশ্রয় লাভকারী শরণার্থীদের জীবনে এগুলো হারিয়ে যাওয়া মনোবল ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছিল। কবিতা ও কবিগান শরণার্থী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলাদের হাত ধরে একাত্তরে অবরুদ্ধ দেশের সিলেট, বিয়ানীবাজার, মৌলভীবাজারের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এসে পৌঁছেছিল। যেগুলো তাদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল। কবিয়াল ও কবিগান শ্রীহট্ট-কাছাড় এলাকার প্রাচীন ঐতিহ্য। যে কোন ঘটনা ঘটলেই স্থানীয় কবিয়ালরা তাকে ছন্দে ধারণ করেন। কবিগান, গীত, লোকগীতি, ভাটিয়ালি গান ইত্যাদি নানাবিধ লোকায়িত ঐতিহ্য ইতিহাসকে এই অঞ্চলের লোক ধারণ করেছেন। জয়বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে অভিঘাত হেনেছিল ভিন্ন এক আবেগে। একদিকে বাঙালিত্বের টান, অন্যদিকে পূর্ব পুরুষদের ভিটে মাটি ছেড়ে আসা পূর্ববঙ্গের সঙ্গে নাড়ির বন্ধন। একাত্তর শ্রীহট্ট-কাছাড় এলাকায় ভিন্ন এক ইতিহাসের জন্ম দেয়। ভাষা, মানবিকতা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সাধারণ তৃণমূলকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দেন। বরাক উপত্যকার কবিয়ালরা স্বভাবতই সেই আবেগী সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন তাদের কথা ও ছন্দে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী আধিপত্যবাদ পল্লী কবির মননে একদিন হাহাকার জাগিয়েছিল। ‘কি হলো রে জান বাংলার ময়দানে উড়ে পাক নিশান।’ স্বশিক্ষিত স্থানীয় কবি ও কবিয়ালরা একাত্তরে ভিন্ন এক সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করেছিল বরাকে। কেউ নতুন গান বেঁধেছেন, পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। আবার কেউবা পুরনো লোকগীতি বা গানে-কবিতায় পরিবর্তন করে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নবরূপে সাজিয়েছেন। হাটে-বাজারে, মাঠে-ঘাটে জয় বাংলা পরিণত হয়েছিল এক আবেগের নামে। মহাবিদ্রোহের কালে রচিত বরাক উপত্যকার জঙ্গীয়ার গীতের অনুকরণে স্থানীয় পল্লীকবি নতুন করে আহ্বান করেছেন: ‘উঠরে জঙ্গীয়া পুআইন কহিলাম সবারে। বাংলার লাগি প্রাণ সঁপিতাম শুভা নাহি আর ওরে।’ (জাগো বিদ্রোহী বাহিনীর বীর সন্তানের, এখন বাংলার জন্য জীবনদানের সময়, এর চেয়ে বড় গৌরব আর কিছু নেই।) একাত্তরের জনযুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা এই অঞ্চলের কবিয়ালরা। নিজেদের অর্থে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ছাপিয়েছেন কবিগান, কবিতা। হাটে, মাঠে, ঘাটে গলা ফাটিয়ে চেষ্টা করেছেন তাদের ছন্দে ও গায়কীতে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে। একাত্তরে লাতু সীমান্তে কবি গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন সত্য নারায়ণ। অসাধারণ গায়কী আর চেহারায় হাটে-বাজারে সহজে লোক জামাতে পারতেন সত্য বাবু। লাতুর মহিশসানে গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। একাত্তরের সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি। জানতে চেয়েছিলাম, একাত্তরে কেন এই পথ বেঁচে নিয়েছিলেন? শুধু সাধারণ মানুষের আবেগকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন কি আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল? আমাকে দেখে আবেগতাড়িত হয়েছিলেন সত্য নারায়ণ। করিমগঞ্জের সর্বশেষ গ্রাম মহিশাসনের এক ভাঙ্গা চায়ের দোকানে বসে নব্বই ঊর্ধ্ব সত্য নারায়ণ বিশ^াস করতে পারছিলেন না তাঁর খোঁজে বাংলাদেশের থেকে আমি এতদূর এসেছি। একাত্তরে কতটা আবেগ দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে কবিগান আর ভাটিয়ালি গানের ছন্দে জনগণের মনকে আন্দোলিত করেছিলেন সেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি। একাত্তরে লাতু বাজারে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি কবিগানের আসর বসাতেন। বলছিলেন সেই সময়ের নানা স্মৃতি। শ্রীহট্ট-কাছাড় এলাকায় এই রকম অনেক সত্য নারায়ণ একাত্তরে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাড়িয়েছিল বন্ধুর সহমর্মী হাত। বরাক উপত্যকায় এই রকম পনেরো জন কবিয়ালের পরিচয় আমি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। যার মধ্য থেকে ৭ জন কবিয়ালের কবিগান আমি সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়। শিলচরের পাথারকান্দির বাউল কবি শ্রীরাইমোহন দেবনাথ। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লিখেছেন দুটি কবিতা। যদিও কবি এগুলোর শিরোনাম দিয়েছেন, ‘জয় বাংলার হত্যাকান্ডের কবিতা’। তবে মূলত এগুলো কবিগান। একাত্তরে শ্রী রাইমোহন ‘জয় বাংলার হত্যাকা-ের কবিতা’ ছাড়াও শরণার্থীদের সহায়তা দেয়ার মিনতি জানিয়ে একটি কবিগান লিখেছিলেন। স্বতঃস্ফূর্ত, অলৌকিক প্রতিভাপ্রাপ্ত কবিত্ব শক্তির নেশায় রাইমোহন হলো ব্যতিক্রমধর্মী। কথায় কথায় হৃদয় থেকে উৎসারিত কবিতার চরণ মুখ থেকে বের হয়ে পড়ে। অসাধারণ তার ব্যঞ্জনা, লালিত্য সুর, ছন্দ। জীবনবাদী রাইমোহনের সমাজের কতিপয় দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ এবং উপলব্ধির বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রথম কবিগানটির মূল্য ছিল ২০ পয়সা। কবিগানটি ছিল ৩ পৃষ্ঠার। কাভার পৃষ্ঠাসহ চার পৃষ্ঠায় নিউজপ্রিন্ট কাগজে এটা ছাপা হয়েছিল। পরের কবিগানটিও ২০ পয়সায় বিক্রি করতেন। একাত্তরে শ্রীহট্ট-কাছাড়ের অন্যতম একজন কবিয়াল ছিলেন শ্রীদিগেন্দ্র কুমার দাস। করিমগঞ্জের বৈঠাখানের ছগলইয়ে জন্ম দিগেন্দ্রের। কবিয়ালের চেয়ে গানের শিল্পী হিসেবে বেশি পরিচিতি তাঁর। একাত্তরে শরণার্থীদের দুঃখগাথা, মুজিবের মুক্তি, টিক্কা খানের মৃত্যু ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে লিখেছেন বেশ কয়েকটি গান। ‘মুক্তি সংগ্রামে জয় বাংলার কবিতা’ শিরোনামে তাঁর একটি কবিগান পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল একাত্তরে। সম্ভবত এর একাধিক খন্ড ছিল। আমি ১ম খন্ডটি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। করিমগঞ্জের মুকুল প্রেস থেকে এটা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশক ছিলেন উদারবন্দের শ্রী রণজিৎ কুমার চন্দ, যিনি করিমগঞ্জ বাংলাদেশ ত্রাণ কমিটির সদস্য ছিলেন। কবিগানের প্রচ্ছদে লিখা আছে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। ত্রাণ কমিটির অনুমোদনক্রমে এটি প্রকাশিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৮ পৃষ্ঠার এই কবিগানের দাম ধরা হয়েছে ৪০ পয়সা। বিংশ শতাব্দীর এজিদ ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টর বর্বরতায় লাখ লাখ শহীদের কবিগান শিরোনামে একাত্তরে ৪টি কবিগান লিখেছিলেন মোঃ আবু বক্কর। শিলচরের ধুমকর গ্রামের এই কবির চারটি কবিগান থেকে আমি মাত্র একটি কবিগান উদ্ধারে সমর্থ হয়। এটি তাঁর তৃতীয় কবিগান। মোঃ আবু বক্কর কবিয়াল হিসেবে বরাক উপত্যকার দীর্ঘদিন জনপ্রিয় ছিলেন। বক্কর কবিয়াল হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। লিখেছেল শতাধিক কবিগান। শিলচর, বদরপুর এমনকি করিমগঞ্জের হাটে-বাজারে তিনি গানের আসর বসাতেন। নিজের প্রকাশিত কবিগান ছাড়াও গান করে তিনি হাটে-বাজারে নানা দ্রব্য বিক্রি করতেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে জানা যায় তিনি খুব ভালো ক্যানভাসার ছিলেন। অতুল চন্দ্র দাস করিমগঞ্জের মোটামুটি পরিচিত কবি। একাত্তরে জয় বাংলার কবিতা শিরোনামে তিনি কবিগান লিখেছেন। কবিগানের উপরে লেখা আছে ১ম ও ২য় খন্ডে সম্পূর্ণ। তবে কোনটা ১ম খন্ড- কিংবা কোনটা ২য় খন্ড- সেটা বুঝা দুষ্কর। কবিগানটি কাভার পৃষ্ঠাসহ চার পৃষ্ঠায় সমাপ্ত। প্রচ্ছদে করিমগঞ্জের মিনার্ভা প্রেস থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা উল্লেখ আছে। প্রকাশনার সন হিসেবে ১৩৭৮ বাং তথা ১৯৭১ সালের কথা উল্লিখিত। অতুল আলাউদ্দিন খাঁর ভক্ত ছিলেন, প্রচ্ছদে ইংরেজীতে তাঁর লেখা রয়েছে রেজিস্ট্রেশন নং। কবির ঠিকানায় তাঁর বাড়ি করিমগঞ্জের বাটিগড়া থানা পশ্চিম গোবিন্দপুরে বলে জানা যায়। একাত্তরে শ্রীহট্ট-কাছাড় এলাকায় শেখ জমির আলী কবিয়াল হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যদিও তাঁর প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে বাড়ি সিলেটের কমলগঞ্জের গুলের হাওড় গ্রামে বলে জানা যায়। তার কবি গানটি সিলেটের আল-আমিন ইলেকট্রিক প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রকাশিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শেখ জমির আলী কাছাড় সীমান্তের পূর্ব বাংলার অধিবাসী। কমলগঞ্জে কবিয়াল হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জমির আলী কিছুদিন কমলগঞ্জে ছিলেন, পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে করিমগঞ্জ শহরে চলে যান। করিমগঞ্জের বিভিন্ন হাটে-বাজারে তিনি জয় বাংলার কবিগান শুনিয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেন। পূর্ব বাংলার কবিয়াল হিসেবে অন্য কবিয়ালদের চেয়ে তিনি আলাদা গুরুত্ব পেতেন। সাধারণ লোকজন আগ্রহী হয়ে ২৫ পয়সার বিনিময়ে তাঁর কবিগান কিনে নিতেন। শিলচরের লোকগীতি সংগ্রাহক ও বাংলার অধ্যাপক অমলেন্দু দের কাছে আমি পাঁচটি লোকগীতির সন্ধান পাই। যেটি একাত্তরের একটি ডায়েরির পাতায় তিনি লিখে রেখেছিলেন। এই কবিগানের পঙ্ক্তিতে কবিয়াল নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। ‘পাগল অশ্বিনী কয় মুজিবের নাও লাগল কিনারায়’। অশ্বিনী সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তবে সংগ্রাহক অমলেন্দু দে’র মতে, এই কবিগানগুলো একাত্তরের অবরুদ্ধ সময়ে তিনি করিমগঞ্জের বাজারে শুনেছেন। এত বেশি কবিগানগুলো তিনি শুনেছেন গানগুলোর কথা তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। জয় বাংলার এই কবিগানগুলো তার তরুণ মনকে নাড়া দিয়েছিল। এই কবিয়ালদের বাইরে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও বদরপুরে অনেক কবিয়াল ছিলেন যারা নিজেরা কোন কবিগান রচনা করেননি, কিন্তু অন্য কবিয়ালের গান গাইত। বিশেষ করে রাইমোহন ও অশ্বিনী বাবুর কবিগান খুব জনপ্রিয় ছিল। কবিয়ালদের অধিকাংশই ছিলেন সমাজের নিচুতলার মানুষ। কবিয়ালগণ তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে কবিতা রচনা করে গেয়েছেন বটে, তবে দুঃখের বিষয় তাঁরা কখনোই এগুলো লিখে রাখেননি বা এসব গান সংরক্ষণের প্রয়োজনীতার দিকটি উপলব্ধি করতে পারেননি। ছাপাখানা থাকলেও তা অনেক ব্যয় সাধ্য ছিল, ফলে অধিকাংশ কবিগান ও কবিয়াল সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছেন। একাত্তরে বরাক উপত্যকার কবিগান ও কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু মোটামুটি একই ধরনের। বরাক উপত্যকার কবিতা ও কবিগানের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে এগুলো অধিকাংশই শুরু হয়েছে প্রভু বন্দনা দিয়ে। এরপর পূর্ব বাংলার ঘটনা প্রবাহের পটভূমি। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য, নানা সময়ে সেই সব বৈষম্যর বিরুদ্ধে বাঙালীদের প্রতিরোধের গল্প বিধৃত হয়েছে এসব কবিগান ও কবিতায়। বড় একটি অংশজুড়ে পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া দুর্বিষহ ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা, বাঙালীদের ওপর নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে এতে। বিশেষ করে বরাকের সীমান্তবর্তী পূর্ব বাংলায় পাকবাহিনীর নির্যাতনের-গণহত্যার বর্ণনা অধিকাংশ কবিতায় স্থান পেয়েছে। পাকিস্তানী বাহিনীর পাশাপাশি তাদের দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনীর কর্মকা- করিয়ালদের পঙ্ক্তিতে বিধৃত হয়েছে। এসব কবিগানের ও কবিতার বিষয়বস্তু মূলত বরাক উপত্যকায় আগত শরণার্থীদের মুখ থেকে শোনা এবং স্থানীয় পত্র-পত্রিকার থেকে প্রাপ্ত। একাত্তরে পূর্ববঙ্গে সংঘটিত নারী নির্যাতন ও গণহত্যা, লুটতরাজের বর্ণনাগুলো বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী আশ্রয়প্রার্থীদের মুখ থেকে করিয়ালরা এসব শুনেছেন। কবিতা ও কবিগানগুলোতে মূলত পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীর ২৩ বছরের শাসন শোষণ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, গণহত্যা, শরণার্থী আগমন ও আশ্রয়, সাধারণের প্রতি শরণার্থী সেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান, মুজিবের মুক্তির দাবি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় উঠে এসেছে। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের তৃণমূল মানুষের সম্পৃক্ততার এক অনন্য নজির এই কবিতা-কবিগান। বরাক উপত্যকার কবিয়ালরা একাত্তরে আবেগাক্রান্ত হয়েছিল জয়বাংলার জন্য। তাদের সেই আবেগ-ভালোবাসা মূর্ত হয়েছে কবিগানের সূর আর ছন্দে। অনেকে এটার মধ্যে শুধু কবিয়ালদের পুস্তিকা বিক্রিকে মুখ্য করে দেখেছেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় আমার কাছে মনে হয়েছে এটা নিছক ভালোবাসার কবিগান। সাধারণের আকাক্সক্ষা স্পষ্ট হয়েছে এসব কবিতা কবিগানে। কবিয়ালরা কবিগানের পুস্তিকা বিক্রির পাশাপাশি চেষ্টা করেছেন, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির। উদ্বাস্তু জীবনে এসব কবিতা-কবিগান আশার সঞ্চার করেছিল শরণার্থীদের। কবিগানের পুস্তিকা বিক্রির টাকা অনেকেই দান করেছেন বাংলাদেশ তহবিলে। কবিয়ালরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে সূর ছন্দে চেষ্টা করেছেন শরণার্থীদের উজ্জীবিত রাখতে, মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই সাংস্কৃতিক প্রয়াস জয়বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে মহিমান্বিত করেছিল। বরাকের সাধারণ মানুষকে সজাগ করেছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। লেখক : বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
×