ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছি ॥ নমিতা ঘোষ

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছি ॥ নমিতা ঘোষ

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম নারী শিল্পী নমিতা ঘোষ। যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। সঙ্গীত সাধনাই যার জীবনের ব্রত। নিরলস চেষ্টা ও অদম্য ইচ্ছাকে আঁকড়ে ধরে যিনি এখনও সঙ্গীত সাধনা করে চলেছেন। সঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিজেকে শিক্ত করার পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীকে মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার সঙ্গীতলব্ধ জ্ঞান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কণ্ঠ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষকে। স্মৃতিময় সেই দিনগুলো নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা বলুন নমিতা ঘোষ ॥ মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা সম্পর্কে অনেকেই অবগত। এর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। সে সময়ের ২৫ ও ২৬ মার্চ কালরাত্রি শেষ হলে ২৭ মার্চ কার্ফু সিথিল করা হয়। এদিন সকালে আমি, বাবা, মা ও ভাই-বোন সবাই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। সদরঘাট লঞ্চঘাটে পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রাস্তায় এলোপাতাড়ি পড়ে থাকা মানুষের মৃতদেহ দেখে দারুণ মর্মাহত হই। নৌকা যখন ছাড়ল মনে হচ্ছিল প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হচ্ছে, এরচেয়ে বেদনার আর কি আছে। ১৬ এপ্রিল আগরতলা রাজবাড়ী ক্যাম্পের স্মরণার্থী হই। আগরতলার স্মৃতিময় দিন কেমন ছিল? নমিতা ঘোষ ॥ সেখানে প্রধান কংগ্রেস নেতা প্রিয়দাস চক্রবর্তী ক্যাম্পে এসে আমার শিল্পীর পরিচয় পেয়ে নরসিংগর পলিটেকনিক্যাল হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আলী আহসান, সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী, মুক্তিযোদ্ধা খসরুসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিবার। সেখানে দেখা হয় শিল্পী মোঃ আবদুল জব্বার ও আপেল মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে। ১৯৬৯ সালে গঠিত হওয়া বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠীর ব্যানারে সবাই মিলে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে গণসঙ্গীত গেয়ে অনুপ্রেরণা যোগাতাম। এ সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে সেখানে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে অর্থ, জামা-কাপড়, খাবার ইত্যাদি সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাঠাতাম। আমার, চিত্রনায়িকা কবরী ও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জন্য সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছিল। সেখানে কিছু কথা ও ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলাম। সেই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি ৭-৮ মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন সিনেমা হলে দেখানো হয়েছিল। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে কিভাবে যোগ দিলেন? নমিতা ঘোষ ॥ স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা বলতে গেলে প্রথমেই সঙ্গীত শিল্পী মোঃ আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, আমি ও স্বপ্না রায়ের কথা আগে আসতে হবে। এই চারজন আগরতলা থেকে সরাসরি স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছি। আমি ১৯৭১ সালের ২৯ মে প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছি। পরে আরও শিল্পীরা আসেন। সাবেক কেবিনেট সেক্রেটারি তৌফিক ইমাম সাহেবের সহযোগিতায় আগরতলা থেকে মে মাসে মা ও আমাকে বিমানে করে কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে সংহতি শ্রী মহিলা হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়। পরে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক আমিনুল হক বাদশা ভাই আমাকে ২৯ মে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেই থেকে প্রথম মহিলা শিল্পী হিসেবে সেখানে কণ্ঠ দিতে থাকি। পরবর্তীতে আরও মহিলা শিল্পী আসেন। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে আপনাদের কর্যক্রম কী ছিল? নমিতা ঘোষ ॥ আমরা সেখানে যে গানগুলো করতাম তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, জয় বাংলা বাংলার জয়, এ ঘর দুর্গ, বিজয় নিশান উড়ছে ওই, নোঙর তোল তোল, শোনা শোনা শোনা, একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছেসহ বেশকিছু কালজয়ী গান। চিত্র পরিচালক দিলীপ সোমের ‘বিক্ষুব্ধ বাংলা’ গীতি আলেখ্য নিয়ে আমরা বোম্বে, দিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশন করেছি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ভারতের অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান, সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখার্জী, সলিল চৌধুরী, সবিতা চৌধুরী, সলিল ঘোষসহ আরও অনেকে। সে সময় আকাশবাণী কলকাতায় থেকে রাগপ্রধান ও নজরুলগীতি পরিবেশন করেছিলাম। আমি বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী নিবেদিত ‘বিক্ষুব্ধ বাংলা’ ও বিচিত্রানুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর আমার কর্মসূচী শেষ করি। -গৌতম পান্ডে
×