ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর

’২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর উন্মোচিত হবে উন্নয়নের মাইলফলক

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

’২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর উন্মোচিত  হবে উন্নয়নের মাইলফলক

এম শাহজাহান ॥ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ‘২০২১’ সালের ১৬ ডিসেম্বর উন্নয়নের মাইলফলক বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হবে। ঐতিহাসিক ওই বছর সামনে রেখে দেশের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ‘২০১০-২১’ শতভাগ বাস্তবায়ন করতে চায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। মূল্য লক্ষ্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে বিশ্ব দরবারে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া। এই লক্ষ্য অর্জনে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, সুবর্ণজয়ন্তীর ওই বছরে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে এবং শুধু পোশাক রফতানি খাত থেকে আয় হবে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পে এমন দীর্ঘমেয়াদী ও বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ নজিরবিহীন ঘটনা। জানা গেছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদী রোডম্যাপ প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০২১ সালের মধ্যে ২ হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত করা, জাতীয় সঞ্চয় ২০২১ সালের মধ্যে মোট জিডিপির ৩৯ শতাংশ অর্জন করা, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ শতাংশ অর্জন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে আলোচিত পদ্মাসেতু চালু ও যানজট নিরসনে ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করা হবে। শুধু তাই নয়, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে ব্যাপক ভিত্তিতে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এজন্য দেশী-বিদেশী এমনকি প্রবাসীদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সবচেয়ে বেশি জরুরী হয়ে পড়ছে। এই চ্যালেঞ্জ অর্জনে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিল্প-সভ্যতার ভিত্তি রচনার জন্য দেশী-বিদেশী এবং প্রবাসী বাঙালী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে আইন ও বিধি সহজ করা, ওয়ানস্টপ সার্ভিস কার্যকর করা, কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমন, বিনিয়োগবান্ধব রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি, অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ, রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণ এবং বিনিয়োগকারীদের যুক্তিসম্মত রাজস্ব ও আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, অর্থনীতির ঘোর অন্ধকারের সময় ২০০৯ সালের শুরুতে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ওই সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুতিমূলক রাষ্ট্র দর্শন, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের সামনে দিন বদলের সনদ তুলে ধরেন, যাতে তিনি ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প উপস্থাপন করেন। বিপুল সফলতার মধ্যদিয়ে ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ সরকার সহ¯্রাবন্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) সমাপ্ত করে। এরপর এবার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত লিড ও সহায়ক মন্ত্রণালয়গুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, বিগত সাড়ে আট বছরের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পদে পদে আঘাত এসেছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদের নামে সহিংস সন্ত্রাসের দ্বারা ব্যাপকভাবে সম্পদ ধ্বংস এবং জীবনহানি ঘটানো হয়েছে। মৌলবাদ শক্তিকে উসকে দিয়েছে। অশুভ তৎপরতার মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। পেট্রোল বোমার সাহায্যে মানুষ পোড়ানোর মতো জঘন্য ধ্বংসাত্বক কর্মকা- চালানো হয়েছে। কিন্তু কুচক্রী মহলের সকল চক্রান্ত নস্যাত করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বেও বিস্ময়রূপে অটল হিমালয়ের মতো চির উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, কর্মসৃজন, খাদ্য উৎপাদন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আমদানি ও রফতানি-এরূপ কোন সূচকেই বাংলাদেশে পিছিয়ে নেই। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন খাতে। দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসসহ আর্থ-সামাজিক খাতের প্রায় প্রতিটি সূচকেই আমাদের অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। তিনি আরও বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে আমরা এগিয়ে এসেছি অনেকদূর। দেশের অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনী কাঠামোকে একটি উন্নত দেশের উপযোগী করে গড়ে তোলার কাজও এগিয়ে চলছে পুরোদমে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) ॥ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যার্জনে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ১৯৭২ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বা এডিপির আকার ছিল ৫শ’ ১ কোটি টাকা, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। আগামী বাজেটের সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এই বাজেটের আকার ৭ লাখ কোটি টাকা করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে, অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনে সাতটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলো হলো- দুর্বল অবকাঠামো, অর্থনৈতিক বহির্মুখিতার অভাব, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, বন্দর সমস্যা, অদক্ষ শ্রমশক্তি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ, জনসংখ্যার চাপ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি। তবে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক গতিশীলতা ধরে রাখার জন্য বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে। তিনি বলেন, জাতীয় সঞ্চয় বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে এ হার আরও বেশি হবে। এই চিত্রই বলে দেয় বিনিয়োগে আমাদের সামর্থ্য আছে। কিন্তু সুযোগ ও পরিবেশের অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। জিডিপিতে কৃষির অবদান কমলেও বেড়েছে শিল্প খাতের। তিনি বলেন, এর অর্থ হচ্ছে অর্থনীতি ক্রমেই কৃষিনির্ভরতা থেকে শিল্প খাতের দিকে ধাবমান হচ্ছে, যা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য নিরসনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার আগেই দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ’২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের স্বীকৃতি ॥ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বা ৫০ বছর পূর্তির সময় ২০২১ সালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। মধ্যম আয়ের স্বীকৃতি দিতে জাতিসংঘ তিনটি সূচক যথাক্রমে মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদের অবস্থান এবং অর্থনীতির ঝুঁকিগ্রস্ততা বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এই তিনটি সূচকের অগ্রগতি ও অর্জন বেশ ভাল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রূপকল্প-২০২১ সালেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের স্বীকৃতি দেবে জাতিসংঘ। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জোর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর ড. খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। এটা জাতি হিসেবে গর্বের। এর ফলে সম্মান বেড়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে যেতে পারলে সম্মান আরও বাড়বে। তবে এজন্য আরও প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাওয়া। এক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় বাড়ানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগের মতো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে।
×