ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি কথা -মুহম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি কথা   -মুহম্মদ শফিকুর রহমান

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সেমিনার শেষ করে বিজয় দিবসের কলাম লিখতে বসলাম। টেবিলের ওপর একটি কাগজ, যাতে তিন দেশের তিনজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচারের কাহিনী লেখা রয়েছে। এই তিনজনের একজন হলেন বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দুর্নীতির অভিযোগে পলাতক (লন্ডনে পলাতক) তারেক রহমানের নামও রয়েছে। দ্বিতীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী হলেন পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত নওয়াজ শরীফ এবং তৃতীয়জন হলেন ইয়ামেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ আল হারিরি। একটি রিপোর্টে দেখলাম কেবল সৌদি আরবেই খালেদা-তারেক (মাতা-পুত্র) পাচার করেছেন ১২ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা টাকার অঙ্কে ৯৬ হাজার কোটি টাকা। আমাদের দুর্ভাগ্য ১৬ ডিসেম্বরের আরাধ্য বিজয় দিবস সম্পূর্ণ আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করতে পারি না। কেননা এর দু’দিন আগেই (১৯৭১) দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। যে কারণে এত বড় আনন্দে কিছু হলেও বেদনার ছায়া পড়ে। তবু ১৬ ডিসেম্বর বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নের বাস্তবরূপ- মহান বিজয় দিবস। তবু কখনও-সখনও এমন আজগুবি সব ব্যাপার সামনে চলে আসে যাকে ভুলে যেতে চাইলেও ভোলা যায় না। তবু এর মধ্যেই আমাদের এগুতো হবে। এবার ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৪৬ বছর পার করে জানলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অর্থ পাচারকারী। কয়েকদিন আগেই জানা গেল আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা বিশ্বের তিন শীর্ষস্থানীয় সৎ রাষ্ট্রনেতার অন্যতম। তার ৩/৪ দিন পর আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির ঘটনা আমাদের লজ্জিত করছে। খালেদা জিয়ার মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম যতই বলুন তাদের নেত্রীর দুর্নীতির এমন কোন খবর কোথাও নেই! কিন্তু শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায়? ২০০১-এ রাজাকার জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর খালেদা জিয়া একবার সপরিবারে সৌদি আরবে যান। সঙ্গে ছিল দেড় শতাধিক স্যুটকেস-ব্যাগ (মতান্তরে আরও বেশি)। তখন এটা নিয়ে বহু গছিপ হয়েছে। কেউ বলেছেন স্যুটকেসগুলো ছিল ডলার-রিয়ালে ঠাসা, কেউ বলেছেন গোল্ড। তাছাড়া মির্জা ফখরুল যতই বলুন এ খবর ঠিক না; কিন্তু তা মানুষ বিশ্বাস করবে না। কারণ খবরটি বাংলাদেশের সংবাদপত্র বা কোন গোয়েন্দা সংস্থা প্রকাশ করেনি, করেছে বিদেশের সূত্র। সৌদি আরবের বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স (ক্ষমতাধর) মুহম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি তার দেশে দুর্নীতিবিরোধী এক অভিযান শুরু করেছেন, যাতে ১১ জন সৌদি যুবরাজসহ ২০১ জন সৌদি প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী রাজনীতিক ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাদের অবৈধ অর্থ সৌদি যুবরাজদের কাছে গচ্ছিত রাখত ও শেয়ারে ব্যবসা করে নিজেরা লাভবান হতো এবং যারা টাকা রাখত তারাও লাভবান হতো। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় তারা টাকা বিনিয়োগ করত এ জন্য যে, এতদিন তাদের, বিশেষ করে সৌদি যুবরাজদের অর্থ-সম্পদের হিসাব দিতে হতো না। কিন্তু বর্তমান যুবরাজ সালমান সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেবেন বলে মনে হয় না। সৌদি আরবের সবচেয়ে ধনী প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল গ্রেফতার হওয়ার পর বলেছেন তার সম্পদের অর্ধেকের বেশিই বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকদের অবৈধ অর্থ। তালাল বহুজাতিক কোম্পানিতে সেই অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং মুনাফা ভাগ করেন। তালাল যে সব বিদেশী রাজনীতিকের নাম বলেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমান, ভাই শামীম ইস্কান্দর। পাকিস্তানের রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। গত ৪ নবেম্বর থেকে ক্রাউন প্রিন্স মুহম্মদ বিন সালমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেন এবং প্রথমদিনই প্রিন্স ওয়ালিদ বিন তালালকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তালাল ঐসব দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেছেন। কে এই তালাল? আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি কয়েক বছর আগে এই বিন তালাল বাংলাদেশে এসে বেশ ঘোরাফেরা শুরু করেন। শোনা গেল তিনি বাংলাদেশের একটি পাবলিক ব্যাংক কিনবেন, সম্ভবত পূবালী ব্যাংক। মতান্তরে রূপালী ব্যাংক। তখনই জানা গেল তিনি তারেক রহমানের কাছের মানুষ এবং পার্টনার। এক পর্যায়ে এও শোনা গেল তিনি আমাদের শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করবেন। এরপরই শেয়ার মার্কেটে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল। মানুষের মুখে তার কথা শুনে মনে হয়েছিল তিনি বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে এসেছেন! সৌদি প্রিন্স তো, নাম শুনলেই আমাদের মাথা ঘুরে যায়। লোকটি ভাল না খারাপ কোন কিছু মাথায় ঢোকে না। সৌদি প্রিন্স যেহেতু, অতএব পবিত্র মানুষ! শেষ পর্যন্ত কি ধরা পড়ল? দুর্নীতি সৌদি আরব পর্যন্ত বিস্তৃত। এক পাশে সৌদি যুবরাজ, আরেক পাশে মিলিটারি জিয়ার মানি ইজ নো প্রোবলেম ম্যাডাম আর তার হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো তারেক জিয়া। নইলে এক দশকের মতো সময় লন্ডনের একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস করছে, পয়সা আসে কোত্থেকে? কেউ কি তার খোঁজ-খবর নিয়েছেন? না কেউ নেননি। প্রিন্স তালালকে ধন্যবাদ তিনি অন্তত খালেদা-তারেকের ব্যয়বহুল জীবনের অর্থের উৎস প্রকাশ করেছেন। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো আমাদের সংবাদপত্র জগত এ ব্যাপারে চুপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এটি যদি তার কিংবা তার পরিবারের ব্যাপারে হতো তাহলে মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ত। যেহেতু এটি খালেদা-তারেকের ব্যাপার তাই মিডিয়া মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, তবে কী সৌদি আরবে স্থাপিত শপিংমলের কার্ড পেয়েছে? নইলে ওই অর্থ-সম্পদ পাচারের খবর ২টি পত্রিকা ছাড়া ক্যানো আর কেউ ছাপল না? কেউ কেউ এতে রাগ করতে পারেন; কিন্তু এ রাগের পেছনেও রয়েছে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রতি মিডিয়াগুলোর সফট কর্নার। বিশেষ করে রাতের টক শোর সর্বজান্তা এবং বিশেষ দৈনিক সংবাদপত্রের কলামের জ্ঞানদানকারী বা মানবাধিকার কর্মী এবং ব্যক্তিত্বকে এ ব্যাপারে কথা বলতে মোটেই শোনা যাচ্ছে না। অথচ এই সিভিল সোসাইটির সে কি আস্ফালন বর্তমান সরকারের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে, অথচ যার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। সরকার যে সব অর্থ ফেরত আনছেন না, কারণ এর সঙ্গে সরকারের লোকেরা জড়িত। এদের সিভিলরা চেনেন, আমি নাম বলে নিজেকে ছোট করতে চাই না। এরা নিজেরাই নিজেদের খাটো করছেন এবং মানুষের সড়ক ছেড়ে নর্দমার পথে হাঁটছেন। নর্দমা দিয়ে হাঁটতে হলে নিজেকে খাটো করেই হাঁটতে হয়। মির্জা ফখরুলদের লজ্জা নেই; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে আমাদের লজ্জা আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সুদীর্ঘ সংগ্রাম শেষে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরই উত্তরসূরি, আমরা মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত সন্তান। আমরা আনন্দিত হই, গর্ববোধ করি যখন শুনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ‘মেধায় সততায় নেতৃত্বে মমতায় বিশ্বসেরা’, যখন শুনি আমাদেরই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সপরিবারে দুর্নীতিপরায়ণ এবং বিদেশে অর্থ-সম্পদ পাচারকারী তখন আমাদের লজ্জা হয়। সর্বশেষ যে তথ্যটি হাতে এসেছে তা হলো ৪ নবেম্বর থেকে শুরু হওয়া দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সৌদি সরকার এ পর্যন্ত ১১ জন যুবরাজসহ যে ২০১ জনকে আটক করেছে তাদের ১৭০০ ব্যাংক এ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। আগেই বলেছি, এ অভিযানের দায়িত্বে রয়েছেন যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমান। যে ১৭০০ ব্যাংক এ্যাকাউন্টও রয়েছে তার মধ্যে বেগম জিয়ার ৫টি এবং তারেকের ২টি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট জব্দ হয়েছে। এবার একটু অন্য কথায় আসি। যে সব মানুষ উচ্চ শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা পবিত্র ইসলামের নামে ওয়াজ করে বেড়ান, তারাও কিন্তু জিয়া পরিবারের দুর্নীতির ব্যাপারে কথা বলেন না। কেন এরা বলেন না তাও বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। আমি যেটুকু বুঝতে পেরেছি তাহলো এই শিক্ষক কিংবা ওয়াজিরা কেউ বাংলাদেশ চাননি, এরা ঠেকায় পড়ে এদেশে আছেন। এরা জিয়া পরিবারের কোন দোষ দেখেন না। এরা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার মূলধারা বিরোধী। এখানেই খালেদা পরিবারের সঙ্গে তাদের মিল। তারপরও ১৬ ডিসেম্বর বহু জনমের আরাধ্য ধন আমাদের বিজয় দিবস। সকলকে বিজয়ের শুভেচ্ছা। সেইসঙ্গে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবার, জাতীয় ৪ নেতা, ৩০ লাখ শহীদ ও ৫ লক্ষাধিক সর্বস্বত্যাগী মা-বোনের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানাচ্ছি। ঢাকা ॥ ৭ ডিসেম্বর ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×