ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ কার্যকর হয়নি

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ কার্যকর হয়নি

আরাফাত মুন্না ॥ বাঙালীর শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার তীর্থভূমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ঐতিহাসিক এই স্থান থেকেই ঘোষণা করা হয়েছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানেই (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল হানাদার পাকি বাহিনী। স্বাধীনতার এত বছর পরেও ঐতিহাসিক এই ময়দানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করা হয়নি। এখনও অরক্ষিত দেশের প্রায় সব বধ্যভূমি। দেশের সব বধ্যভূমি খুঁজে বের করাও কষ্টকর হয়ে গেছে। এসব বধ্যভূমির অনেক জায়গা হয়ে গেছে বেদখল। ফলে অনেক ঐতিহাসিক স্থান এখনও নতুন প্রজন্মের অগোচরেই রয়ে গেছে। ২০০৯ সালে হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সারা দেশের বিভিন্ন স্থানের বধ্যভূমি সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। রায়ের ৮ বছর পার হলেও উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি। তৎকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (সাবেক প্রধান বিচারপতি, বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান) ও বিচারপতি মোঃ মমতাজ উদ্দিন আহমেদের বেঞ্চ এ রায় দেন। পরে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি লেখেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। ‘৩৫ বধ্যভূমি ও স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণ করতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পটি ২০০৮ সালে সমাপ্ত হয়। এই প্রকল্পের কার্যক্রম দৃশ্যমান না হাওয়ায় আদালতে জনস্বার্থে রিট আবেদন দায়ের করা হয়। সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব) কেএম শফিউল্লাহ, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ হাইকোর্টে এ রিট আবেদন করেন। শুনানির পর ২০০৯ সালে ৮ জুলাই হাইকোর্ট ওই ঐতিহাসিক রায় দেন। হাইকোর্টের ওই রায়ে, কমিটি গঠনের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সব ঐতিহাসিক স্থাপনা চিহ্নিত করে সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অবহেলা-অযত্নে পড়ে থাকা বধ্যভূমি এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র চিহ্নিত করতে বলা হয়। এছাড়া দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ, সমাধিক্ষেত্র, স্মৃতিফলক, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে স্থানগুলো সংরক্ষণের নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংরক্ষণের বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ উদ্যানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ উদ্যানেই ভাষণ দিয়েছিলেন। এ উদ্যানে দাঁড়িয়েই শপথ গ্রহণ করেছিলেন ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানী বাহিনীর এ উদ্যানে আত্মসমর্পণ, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ এ উদ্যানেই। রায়ে বলা হয়, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, প্রাচীনকাল থেকে রাজা-বাদশাগণ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে গিয়েছেন। ওই সকল স্থাপনা তৎকালীন সভ্যতার সাক্ষ্য বা নিদর্শন হিসেবে রয়েছে এবং ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন- প্রাচীন মিসরের পিরামিড, স্ফিংস ও ফারাওদের মূর্তি, গ্রীক এবং রোম সভ্যতার বিভিন্ন স্থাপনা উল্লেখযোগ্য। রায়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে অংশে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল, উদ্যানের সেই অংশটিকে ‘স্বাধীনতা উদ্যান’ নামকরণের জন্য আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। বধ্যভূমির বিষয়ে রায়ে বলা হয়, শতবর্ষ পরে হলেও আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এই বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত তাদের পূর্ব পুরুষগণের আত্মত্যাগকে সম্মান প্রদর্শন করবে। এই সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা একটি আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। রায়ে বলা হয়, এই সকল বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যত প্রজন্ম উপলব্ধি করবে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে, সম্ভ্রমের বিনিময়ে তারা আজ গর্বিত জাতি। রায়ে আরও বলা হয়, তারা স্মরণ করবে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মীরমদন, মোহনলালকে; তারা স্মরণ করবে তিতুমীর, প্রফুল্ল চাকি, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ইলা মিত্রকে। তারা নীরবে স্মরণ করবে আরও নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা মনে মনে বলিবে, চুপ! আস্তে!! খুব আস্তে, ধীরে, ‘তিষ্ঠ ক্ষণকাল; এই স্থানে আমাদের বীরগণ চিরনিদ্রায় শায়িত!! আমরা ভুলি নাই, আমরা আত্মত্যাগের কথা ভুলি নাই!! ভুলিতে পারি না!! এই রায়ের পর ২০১০ সালের শেষদিকে বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ (২য় ধাপ)’ নামের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশের ২০৪ বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়। এসব বধ্যভূমিতে ২ হাজার ৯৮৪ সমাধি চিহ্নিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় প্রথমে দেশের ১৭৬ বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে পরে ১২৯ বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলেও সেখান থেকে তা দু’দফায় নতুন নতুন তথ্য চেয়ে ফেরত পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে চাহিদা অনুযায়ী তথ্য দিয়ে সেটি আবারও পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। কিন্ত এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের আমলে এই কাজ শেষ করা যাবে কিনা, তা নিয়ে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়েরই কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। কারণ প্রকল্পের মেয়াদই ধরা হয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন করা না গেলে এই সরকারের বাকি সময়ে কাজটি করা যাবে না। তার অর্থ এটির বাস্তবায়ন প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে আরও পিছিয়ে যেতে পারে। যদিও আশার কথা শুনিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব অপরূপ চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রকল্পটি অনুমোদন ও বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা আশাবাদী। এখন এটি পরিকল্পনা কমিশনে আছে। প্রকল্পটির বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু বিষয় জানতে চাওয়া হয়, সে চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। এখন অপেক্ষা অনুমোদনের। প্রকল্পের প্রস্তাবনা (ডিপিপি) থেকে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় রয়েছে সারাদেশে ২৭৯ বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ। ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে মোট ব্যয় হবে ৩৫০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, বর্তমান সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হিসেবে জাতি গণ্য করে। কিন্তু এ সরকারের আমলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার রায় উপেক্ষিত। কেন সরকার এ রায় বাস্তবায়ন নিয়ে কালক্ষেপণ করছে তা বোধগম্য নয়। তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানগুলোও চিহ্নিত করা হয়নি। তিনি এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে এসব ঐতিহাসিক স্থানের সঙ্গে সরাসরি যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের দিয়ে চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যারা সরাসরি জড়িত ছিল, তারা মারা গেলে তো আর এগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না।’
×