ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন ॥ লেক ক্যাথেলিন - ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন ॥ লেক ক্যাথেলিন - ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

(পূর্ব প্রকাশের পর) তথ্যকেন্দ্রের বাইরে এসে অনেকটা সময় অতিবাহিত করলাম চারদিকের নিকট ও দূরের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের উঁচু শীরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে। আমাদের দেশের কবিরা গল্প গানে গদ্যে কবিতায় সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার রূপ রস গন্ধের যে মনোমুগ্ধকর রূপ বৈচিত্র্যের বর্ণনা দিয়েছেন, তাঁরা যদি এসব দেশে এসে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপ লাবণ্য নিয়ে গল্প কবিতা লিখতেন তবে সেটা কেমন হতো সেটাই ভাববার বিষয় ছিল। কবি বলেছেন এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভাল। তবুও সে মরণ স্বর্গ সমান। এখানে মরতে চাঁদের আলোর প্রয়োজন নেই। যে কোন সময় এখানে মরতে রাজি আছি। স্বর্গেরও প্রয়োজন নেই। নিশ্চয় সে স্বর্গ এ স্বর্গের তুলনায় কোন অংশে ভাল হবে না। আমার এসব ভাবনায় স্বপন এসে বিঘœ ঘটাল বলল- চল এবার লেক ক্যাথেলিন যাব। বেশি দূরে নয়। এখানকার প্রত্যেকটা লেকের অনন্য সাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। কোনটাকে কোনটা থেকে তুল্যমূল্য বিচারে আলাদা করার কোন উপায় নেই। আবার প্রত্যেকটার কিছুটা স্বকীয়তা আছে লেক ক্যাথেলিনের স্বকীয়তা হলো এখানে মিষ্টি জলের কড়শধহবব স্যামন মাছের চারণ ভূমির জন্য স্যামন শিকারিদের আনাগোনা একটু বেশি। এই প্রজাতির স্যামন মাছের জন্ম ও মৃত্যু এই মিষ্টি জলেই। তারা কখনও সাগরের লবণাক্ত জলের স্বাদ গ্রহণ করার প্রয়োজন মনে করে না। ওরা এভাবেই জন্মে, বড় হয়, বংশবিস্তার করে আবার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, একটা বাঁধাধরা জীবনযাপনের পরে। এই কড়শধহবব ভূমি দ্বারা আবদ্ধ ংড়পশবুব স্যামন। এদের ওজন এক কেজির একটু বেশি হতে পারে। তবে লম্বায় কুড়ি ইঞ্চির বেশি হয় না। গায়ের রং উজ্জ্বল সিলভার, তবে ডিম পাড়ার সময় হলে লাল রং ধারণ করে। এরা সাধারণত গভীর জলে থাকে এবং ুড়ড়ঢ়ষধহশঃড়হ এবং পযরৎড়হড়সরফ লারভা প্রধান খাদ্য। যাই হোক দেখা হলো দু-একজন মৎস্য শিকারির সঙ্গে। তবে তখনও পর্যন্ত ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। লেকের ধার দিয়ে অন্যদের মতো আমরাও অনেকটা পথ ইকো ট্যুরিজম করে আসলাম। আজ হাতে সময় কম অনেক জায়গায় যেতে হবে। এর পরের আকর্ষণ কি তা জানা নেই। বন্ধুপতœী ও বন্ধুবর যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই আমাদেরও গন্তব্য। তবে একটা বিষয় সর্বদা মাথায় রাখতে হচ্ছে যে, এটা বিয়ার কান্ট্রি, বিয়ারদের থেকে একটু সতর্ক থাকা আবশ্যক। সর্বত্র এই বাণী সংবলিত বিল বোর্ডের ছড়াছড়ি। রক গ্লাসিয়র হেন্স জাঙ্কশন ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে আসলেই এই প্রকৃতির লীলা খেলা দেখার সৌভাগ্য জুটে যাবে। নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি পার্ক করতেই চোখে পড়ল ‘তুমি এখন বিয়ার কান্ট্রিতে।’ আরও গা ছমছম করতে লাগল এই কারণে যে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। উঠতে হবে সেই পাহাড়ের চূড়ায়। অবশ্য চূড়ায় না উঠেও মাঝ পথে দেখা মিলে যেতে পারে এই দুর্লভ জিনিসটির, সেই কথাই বন্ধু জানালেন। বিয়ার কান্ট্রিতে চলতে হলে কাছে এক ধরনের স্প্রে রাখা জীবনের ঝুঁকি কমানোর জন্য আবশ্যক। বিয়ার কাছে আসলে স্প্রে মারলেই ওরা চোখে কিছুই দেখতে পায় না। তবে বাতাসের গতিবিধির ওপর নির্ভর করে না মারলে নিজের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতে পারে। স্বপন সেদিন স্প্রে আনতে ভুলে গিয়েছিল, তাই এতটা শঙ্কিত। দল বেঁধে ও জোরে কথা বলতে বলতে গেলেও কিছুটা নিরাপদ থাকা যায়। যাহোক তার দর্শন লাভে ব্যর্থ হয়েই সেদিনের রকি গ্লাসিয়ার দেখতে পেরেছিলাম। এই ইউকন টেরিটরিতে আগমনের পূর্বে গ্লাসিয়ার সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। প্রথম, শব্দটির সঙ্গে পরিচয় হলো ক্যালগেরিতে এসে। শব্দটির আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় বরফের স্তূপ বা বিশাল আকৃতির বরফ খ- ধসে পড়া। বছরের পর বছর জমতে জমতে আপন ভারে নুয়ে কিংবা ধসে পড়ে। সেটা বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক ও আবহাওয়াজনিত জটিলতার কারণে ঘটতেই পারে। কিন্তু রক ধসে পড়া তাও একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। বিষয়টির জটিলতা বুঝতে অনেক সমস্যায় পড়তে হলো। জানা মতে দুইটা প্রধান কারণ ভূতত্ত্ব¡ বিশেষজ্ঞরা ধরতে পেরেছেন। প্রথমত অতিমাত্রায় বরফের ভেলোসিটি কমে যাওয়া এবং দীর্ঘদিন তুষার জমে থাকা। অর্থাৎ রকি পাথরের মধ্যে বরফের আয়োতন বেড়ে গেলে এমনটি হতে পারে। রকের মধ্যে জমে থাকা বরফের ফুলে ফেঁপে ওঠা ও নি¤œমুখী গতির করণে গ্লাসিয়ারের এমন ঘটনা ঘটে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কোন কোন রক গ্লাসিয়ার তিন কিলোমিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ও ষাট মিটার উচ্চতাসম্পন্ন হতে পারে। যাহোক এই দুর্ভেদ্য বিষয়টি আমার মাথায় ঢুকবে না। নিশ্চয় আরও অনেক জটিল বৈজ্ঞানিক কারণ আছে। বরং যে জিনিস দেখে আসলাম তার একটা বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। ভল্লুক সংক্রান্ত সম্ভাব্য বিপদসঙ্কুল বনবীথি অতিক্রম করে পদার্পণ করলাম গ্লাসিয়ারের সীমানায়। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শিলাখ- ছড়িয়ে রয়েছে। দেখে মনে হতে পারে বৃহৎ শিলাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে রাখা হয়েছে। কিংবা অনুমান করা যাক, হাত থেকে একটা কাঁচের বড় আকারের পাত্র বা কাঁচের যে কোন দ্রব্যসামগ্রী পাথরের মেঝের ওপর পড়ে গেলে কাঁচের টুকরোগুলো মেঝের ওপর যেমন করে ছড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনি কোন ঘটনার কারণে এমনটি হয়েছে। অর্থাৎ বিশাল আকৃতির শিলাকে অনেক উঁচু থেকে ফেলে এমনটি ঘটানো হয়েছে। সত্যি এমন অনেক ঘটনাই দুনিয়াজুড়ে ঘটে আছে যা দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। ধারণা করা হয় বরফ যুগের শেষ সময়ে এখান থেকে ৩০০-৪০০ বছর পূর্বের এই ঘটনা। আস্ত একটা পাথরের পাহাড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পড়ে আছে। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল পাথরের স্তূপের মধ্যে। এটা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। এমন ঘটনা এখন ঘটার জন্য যে তাপমাত্রার প্রয়োজন সেই তাপমাত্রা নিশ্চয় এখন নেই। বায়ুম-লে তাপমাত্রার উষ্ণতা বৃদ্ধি অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে ফিরতি পথ ধরলাম। আবারও ভল্লুকের শঙ্কা পেয়ে বসল। তবে এ যাত্রায় রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হয়ে গেল। অর্থাৎ গ্লাসিয়ার দেখলাম এবং পাহাড়ে চড়লাম। যদিও খুব বেশিদূর উঠতে হয়নি তবুও যেটুকু হলো নেহায়ত কম নয়। গ্লাসিয়ারের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে চারদিকের যে ভিউ দেখা গেল সেটাই বা কম কিসে। আসলে এদিককার ভিউটাই আসল। আর তার সঙ্গে যদি বিশেষ কোন বিষয়াদির সংমিশ্রণ ঘটে তবে সোনায় সোহাগা। এমনি করেই বউদি ও স্বপন বাবুর কল্যাণে এতদাঞ্চলের যতকিছু বিচিত্র, যতকিছু হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যত কিছুতে মনোরঞ্জন হয় তার সবই এক এক করে দেখে যেতে থাকলাম। এমনি করেই সকলেই অবদান রেখে চলেছেন আমাদের কানাডা ভ্রমণকে সার্থক করে তুলতে।
×