ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মায়াবী নিঝুম দ্বীপে দুই দিন -মো. সাইফুল আলম

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

মায়াবী নিঝুম দ্বীপে দুই দিন -মো. সাইফুল আলম

নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার পথ দুইটা। একটা হলো ঢাকার সদরঘাট থেকে নদীপথে লঞ্চযোগে সরাসরি হাতিয়া হয়ে। অন্যটা হলো ঢাকা থেকে সড়কপথে নোয়াখালীর চেয়ারম্যানঘাট, তারপর নৌপথে হাতিয়া হয়ে। হাতিয়ার সর্ব দক্ষিণে নিঝুম দ্বীপ। তবে প্রথম পথটা সহজ আর আরামদায়ক। ভ্রমণসঙ্গী চারজন ঠিক সময়ের পূর্বেই সদরঘাটে এসে হাতিয়াগামী লঞ্চে উঠে পড়লাম। বিকেলে ছেড়ে দিয়ে লঞ্চটি পরদিন সকাল ৮টায় হাতিয়ার তমরুদ্দিনঘাটে এসে থামল। ঘাট থেকে রিক্সায় করে হাতিয়ার মূল কেন্দ্র ওসখালীর একটা হোটেলে উঠে সেই দিনটা হাতিয়ায় কাটিয়ে দিলাম। পরদিন খুব সকালে রিজার্ভ করা বেবিট্যাক্সি করে জাহাজমারা ইউনিয়নের মুক্তারিয়াঘাটে এলাম। এখান থেকে মেঘনা নদীর ছোট্ট একটা শাখা পার হলেই নিঝুম দ্বীপ। এপাড় থেকেই দ্বীপের বন দেখা যায়। পারাপারে ব্যবস্থা ইঞ্জিনচালিত নৌকা, মিনিট দশেকের মধ্যেই নিঝুম দ্বীপের ঘাটে এসে নামলাম। দ্বীপের মধ্যে চলাচলের রাস্তাগুলো পাকা আর ইট বিছানো। যাতায়াতের জন্য রিক্সা আর মোটরসাইকেলের ব্যবস্থা আছে। নিঝুম দ্বীপের অপর নাম চর ওসমান। ওসমান নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম এ দ্বীপে গোড়াপত্তন করেন বলেই এ নাম হয়েছে। নিঝুম দ্বীপের মূল আকর্ষণ হলো বনের অজ¯্র্র হরিণ আর দ্বীপজুড়ে থাকা অসংখ্য পাখির আবাসস্থল। কিছু দুর্লভ পাখি এখনও টিকে আছে এ দ্বীপে। সমুদ্র থেকে চর জাগার পর বন বিভাগ এখানে বনায়ন করে। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে ছয় জোড়া হরিণ এ দ্বীপে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে এ সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় চল্লিশ হাজারের কোঠায় পৌঁছেছে। এ বনে কোন বাঘ, চিতা বা অন্য কোন হিং¯্র প্রাণী না থাকায় হরিণেরা পেয়েছে নিরাপদ আশ্রয় স্থান। যে কারণে সংখ্যার এ আধিক্য। এত এত হরিণ তাই বলে আপনি দ্বীপে আসা মাত্রই কিন্তু এদের দেখা পাবেন না। এর জন্য আপনাকে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। শুরুতেই আমরা ঘণ্টা হিসেবে দুইটা রিক্সা ভাড়া করলাম। প্রথমে এলাম এখানকার একটা বাজার বন্দর টিলায়। নাস্তা পর্বটা এখানে শেষ করলাম। নাস্তার শেষাংশে ছিল এখানকার বিখ্যাত মহিষের দই। এটা এতটাই স্বাস্থ্যসম্মত আর স্বস্তিকর যে আমরা নিশ্চিত সেটা সারাদিন আমাদের ভাল রাখবে। বাজারে বসে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে দ্বীপ সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে নিলাম। দ্বীপের পশ্চিমাংশে বন আর দক্ষিণাংশে সৈকত। এবার আমরা যাচ্ছি নামা বাজারের দিকে। বাজারটা বনের ধারে, কাছেই লোকালয়। বাজার সংলগ্ন রিসোর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হবে। পথের দু’ধারে দিগন্ত জোড়া ধানী জমি, খোলা মাঠ আর বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতবাড়ি দেখতে দেখতে নামা বাজারে এসে নামলাম। ব্যাগ ব্যাগেজ রিসোর্ট রেখে দ্রুত বের হয়ে গেলাম। কিছুটা পথ রিক্সায় আর কিছুটা পথ হেঁটে দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের সৈকতে এলাম। মাটির সৈকত পা ডেবে যাচ্ছিল। সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউগুলো তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। জায়গাটি অসংখ্য পাখিদের ওড়াউড়ি আর কলকাকলিতে মুখরিত। পাখিদের মধ্যে গাংচিলই বেশি। এ যেন দেশী-বিদেশী পাখিদের মিলনমেলা। সৈকতের একাংশে আছে বেশ কয়েকটি খেজুরগাছ। খেজুরগাছ সংলগ্ন সমুদ্রতটটি বালু দিয়ে তৈরি। জুতা খুলে লোনা পানিতে পা ভিজালাম। মধ্য দুপুরে সাগর দেখে ফেরার পথে বেশকিছু মহিষের পাল দেখতে পেলাম। সেখান থেকে নামা বাজারে রিসোর্টে চলে এলাম। সামুদ্রিক মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। দ্বীপবাসীরা জানাল প্রতিদিন বিকেলে হরিণগুলো ঘাস খাওয়ার জন্য বন থেকে বের হয়ে আসে। এদেরই এক কিশোর রফিককে গাইড হিসেবে নিলাম। বিকেলে সে আমাদের বনের ধারে বিস্তীর্ণ ঘাসে ভরা মাঠের কাছে নিয়ে গেল। আমরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। পড়ন্ত বিকেলে ছোট ছোট দলে হরিণগুলো বন থেকে বের হয়ে ঘাস খেতে এলো। প্রায় শ’খানেক তো হবেই। এর মধ্যে কোনটা হাঁটছে কোনটা দৌড়াচ্ছে আবার কোনটা খেলার ছলে লাফাচ্ছে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। সামনা সামনি ঢিল ছোড়া দূরত্ব থেকে এতগুলো হরিণ দেখে উত্তেজনায় চরমে পৌঁছলাম। হরিণগুলোর মধ্যে অনেকগুলোকে দুর্বল মনে হলো। এখানে হরিণদের খাদ্যের চরম অভাব। প্রাণী বিশারদদের মতে এ বনে দশ হাজারের মতো হরিণ বাস করার পরিবেশ আছে। কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা প্রায় চল্লিশ হাজার। দুর্বল হরিণগুলো স্থানীয় কুকুরদের সহজ শিকার। কুকুরগুলো দলবদ্ধভাবে বনে ঢুকে তাদের আক্রমণ করে মেরে ফেলে, তাদের তাজা মাংস খেয়ে খেয়ে কুকুরগুলো অনেকটাই বন্য প্রকৃতির আর চেহারাগুলো নাদুস নাদুস করে ফেলেছে। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে রিসোর্টে ফিরে এলাম। বাজারে রাত্র ১১টা পর্যন্ত জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুত সরবরাহ থাকে, তাই এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় কাজ সেড়ে সারা দিনের কান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে রফিককে নিয়ে বের হলাম বনের গভীরে হরিণ দেখার জন্য। বনে হরিণ চলাচলের রাস্তা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। গ্রামের মেঠো পথের মতো। সেই পথে তাদের পদচিহ্ন আর বিস্টাও পেলাম। বনের গভীরে বন বিভাগ বেশকিছু পুকুর কেটেছে হরিণদের সুপেয় পানির জন্য। শুনেছি হরিণগুলো দলে দলে এখানে পানি খেতে আসে। এ রকম একটা পুকুরের পাড়ে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। নির্জন বনে অনবরত পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। বনের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া মশার উপদ্রব তো আছেই। বিরক্তকর ঘণ্টাখানেক অপেক্ষায় মাত্র ১০-১২টি হরিণকে পানি খেতে দেখলাম। বনে হরিণের খাবারের যে তীব্র অভাব তার প্রমাণ আবারও পেলাম। বড় গাছগুলোর গোড়া থেকে যতটা উচ্চতায় সম্ভব হয়েছে ছাল-বাকল খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে তারা। এমনকি মাঝে মাঝে কৃষকের সবজি ক্ষেতেও হানা দিয়ে থাকে হরিণগুলো। সাগরে এখন জোয়ার। বনের ভেতরের ছোট-বড় খালগুলো পানিতে পরিপূর্ণ। রফিকে দিয়ে একটা ছোট মাছ ধরার নৌকার ব্যবস্থা করলাম। ঝটপট নৌকায় উঠে বসলাম। গভীর বনের ভিতর দিয়ে মাঝি ধীরে ধীরে নৌকা বেয়ে চলছে। খালের দু’ধারে গাছের ডালগুলোতে শঙ্খ-চিল, ভুবন বিল আর মাছরাঙারা মাছ শিকারের অপেক্ষায় অলস সময় কাটাচ্ছে। সুনসান নীরবতা। বন আর খালের মাঝে খোলা ঘাসে পরিপূর্ণ সমতল জায়গায় বেশ কিছু হরিণের দেখা পেলাম। আমাদের দিকে মাথা উঁচু করে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল কিছুক্ষণ, তারপর ভোঁ দৌড় বনের গভীরে। দুপুরের পর পর নামা বাজারের রিসোর্টে ফিরে এলাম। চমৎকার একটা ভ্রমণের আনন্দকে সঙ্গে নিয়ে নিঝুম দ্বীপ ছাড়ার প্রস্তুতি নিলাম।
×