ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিক্রি নেই অথচ নামী কোম্পানিগুলো সমানে ঋণ নিচ্ছে -ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

বিক্রি নেই অথচ নামী কোম্পানিগুলো সমানে ঋণ নিচ্ছে -ড. আর এম দেবনাথ

অর্থনীতির বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রের খবরই ভাল। আমদানি, রফতানি, রেমিটেন্স, মূল্যস্ফীতির খবর ভাল। অবশ্য এর আগেই ভাল খবর পেয়েছি গত অর্থবছরের। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ওই বছর প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এটা আশাতীত সাফল্য। এত প্রবৃদ্ধি আমাদের অঞ্চলের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, কৃষি এবং সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। প্রশ্ন ছিল এই প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখার। এতেই সন্দেহ ছিল অনেকের। কিন্তু সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো ঠিকই চলছে। যেমন, প্রথমেই যদি রফতানির কথা ধরি তাহলে দেখা যাচ্ছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ হারে। অর্থবছরের জুলাই থেকে নবেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ১ হাজার ৪৫৬ কোটি ২৯ লাখ ডলারের পণ্য ও সেবা রফতানি হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রানুযায়ী রফতানি বৃদ্ধি পায়নি। এ প্রেক্ষাপটে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রানুযায়ী রফতানি করতে আরও গতিশীল হতে হবে বলে সবারই ধারণা। এদিকে আমদানির অবস্থাও ভাল। ২০১৭ সালের নবেম্বর মাসে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৩ শ’ ৩৩ মিলিয়ন ডলার। অবশ্য এর মধ্যে বড় একটা সরকারী ঋণপত্র ছিল। ‘বাংলাদেশ এ্যাটমিক এনার্জি কমিশন’ রূপান্তর আণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য ঋণপত্র খুলেছে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের। সেপ্টেম্বর মাসে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩৫৯ মিলিয়ন ডলার। জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঋণপত্র খোলার পরিমাণে ওঠা-নামা থাকলেও গড়ে আমদানি ঋণপত্র বৃদ্ধির দিকে। ঋণপত্র খোলার তথ্য থেকে বোঝা যায় আমদানিতে কাঁচামাল যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবর্তী পণ্য এবং যন্ত্রপাতি বা মূলধনী যন্ত্রপাতি। অবশ্য সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে চাল ও গমের জন্য ঋণপত্র খুলতে হয়েছে। তাও কম নয়। বন্যায়, বলা যায় দুইবারের বন্যায় ধান-চালের ক্ষতি হওয়ায় এবার কিছু বেশি পরিমাণ চাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে হয়েছে। সার্বিকভাবে অবশ্য শিল্প উৎপাদন এবং শিল্পায়নের অনুকূলেই আমদানি বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে বলে ধারণা, যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভিন্ন মতও দেখা যায়। এদিকে বাজারের খবর যাই হোক না কেন ‘বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস (বিবিএস)-এর মতে, গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি সামান্য হ্রাস পেয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। অক্টোবরে তা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। নবেম্বর মাসের তথ্য হাতে নেই। এই মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্য, শাক-সবজির মূল্যে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। এমতাবস্থায় নবেম্বরে মূল্যস্ফীতির হারের ওপর ভাল খবর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির বড় একটা সূচক। এই সূচক বলে দেয় সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা কেমন? তাদের দৈনন্দিন জীবন কষ্টের, না একটু স্বস্তির? সবচেয়ে বড় খবর একটা আছে এবং তা বেসরকারী ঋণ প্রবাহের ওপর। বেসরকারী ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে আমরা বলি ব্যবসা-বাণিজ্য ভাল চলছে। শিল্প ভাল চলছে। ব্যবসায়ীরা এতে শান্ত থাকে। ব্যাংকগুলোও শান্ত হয়। তাদের কাজ বাড়ে। ‘প্রফিট’ বাড়ে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ বেশি বাড়লে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা হচ্ছে ঋণ বাড়ছে, কিন্তু তা বাড়বে পরিমাণ মতো যাতে মূল্যস্ফীতি না হয়। আবার ঋণ বেশি বাড়লে আরেকটা ক্ষতি আছে। ঋণের টাকা এদিক সেদিক হতে পারে। অর্থাৎ ঋণের টাকা ‘ডাইভার্টেড’ হতে পারে, এমনকি তা চলে যেতে পারে বিদেশে। এমন একটা পরিস্থিতি আবার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে? কারণ দেখা যাচ্ছে বেসরকারী খাতের ঋণ বাড়ছে অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ বৃদ্ধির টার্গেট থাকে। এবারের টার্গেট ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ ঋণ বাড়ছে ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। চিরায়ত যুক্তি দিয়ে বিচার করলে খুবই ভাল লক্ষণ। বেসরকারী খাতে ঋণ বাড়ছে। লক্ষণীয়, সরকারী খাতে নয়। সরকার বরং ঋণের টাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় মনে হতেই পারে বেসরকারী খাতের ঋণ বৃদ্ধি একটা ভাল লক্ষণ। কিন্তু ডলারের মূল্য বৃদ্ধি কি এর জন্য দায়ী? বেশি বেশি চাহিদা তৈরি হচ্ছে। কারণ বেশি বেশি ঋণ মানে বেশি বেশি ঋণপত্র। অর্থাৎ আমদানি, যার জন্য দরকার ডলার। নবেম্বর-ডিসেম্বর মাসের দিকে হঠাৎ করে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? এর কারণ কি এই যে, আমদানির জন্য ডলার দরকার? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বেশি বেশি বেসরকারী খাতের ঋণবৃদ্ধির সমূহ ক্ষতির দিক আছে। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে আমাদের ‘কর্পোরেট সেক্টর’ অতিরিক্ত ঋণ করে ফেলেছে। যাকে বলা যায়, ‘ওভার বরোড’ তাদের অবস্থা। অনেকের ধারণা, যেসব কোম্পানির ঋণকে ‘পুনর্গঠন’ করা হয়েছে তারা বস্তুত পক্ষে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেঁসে গেছে। তাদের ‘ক্যাশ ফ্লো’ কম। অর্থাৎ টাকার আমদানি কম। অর্থাৎ বেচা-কেনা, রফতানি কম। টাকার আয় কম। অথচ যে পরিমাণ ঋণ তারা নিয়েছে তার জন্য যে কিস্তি আসে তার পরিমাণ অনেক। এমতাবস্থায় ‘পুনঃ তফসিল’ (রিসিডিউলিং) যথেষ্ট নয়। তাই তাদের জন্য সুদের হার হ্রাস করা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ ‘গ্রেইচ পিরিয়ড’ দেয়া হয়েছে যাতে তারা ‘দম’ নিতে পারে। এটা কেন হলো? হয়েছে ৭-৮ বছর আগে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। ১৬-১৮-২০ শতাংশ হারে। এই হারে ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া একটা কুলক্ষণ। অথচ তাই ঘটেছিল। সস্তায় এবং বিনা আয়েসে এই ঋণ নিয়ে ঋণের অপব্যবহার করেছে অনেকেই। অভিযোগ আছে তাদের কেউ কেউ বিদেশে টাকা পাচার করেছে। কেউ কেউ জমি কিনেছে বাংলাদেশের সর্বত্র। এসব করে অর্থ সঙ্কটে পড়েছে। ব্যবসা বাড়েনি, রফতানি বাড়েনি, বিক্রি বাড়েনি। তাদের বেড়েছে ঋণ। অর্থাৎ ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে বিক্রির কোন সম্পর্ক ছিল না। এই সঙ্কট মোকাবেলাতেই প্রধানত ‘লোন রিস্ট্রাকচারিং।’ কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। অনেকে পুনর্গঠিত ঋণের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না বলে খবর পাওয়া যায়। দুই-তিন দিন আগে একটা খবর দেখলাম। সেখানে ১০-১১টা বড় বড় কোম্পানি ঋণ নিয়েছে প্রচুর। নিয়েছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। অথচ তাদের বেচা-কেনা সেভাবে বাড়েনি। তথ্যে যা দেখানো হয়েছে তা খুবই উদ্বেগজনক। ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩০০ শতাংশ অথচ বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২৬ শতাংশ। ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫০০ শতাংশ, অথচ বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৬২ শতাংশ। কী মনে হয়? কোম্পানিগুলোর নাম দেখে পরিষ্কার মনে হয় ব্যাংকগুলো ‘খাতির’ করে ঋণ দিয়েছে। এখানে কোন বাছ-বিচার ছিল না। ব্যবসায়িক কোন বিবেচনা ছিল না। যদি থাকত, তাহলে তারা এত টাকা ঋণ নিতে পারত না। এসব ঋণের বিপরীতে কী ‘কোলেটারেল’ আছে? আমি নিশ্চিত নই। আর ‘কোলেটারেল’ দিলে কি ব্যাংক ঋণ দেয়? না, দেয় না। ব্যবসা থাকতে হয়। এমতাবস্থায় আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলব বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের দেখা দরকার এসব কোম্পানি টাকা নিয়ে কী করেছে? ব্যবসা বাড়ল না, বিক্রি বাড়ল না অথচ প্রচুর ঋণ বাড়ল এর কারণ কী? এর কী ঋণপত্র খুলেছে? কীসের জন্য খুলেছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। এখানেই আমার প্রশ্ন বেসরকারী খাতে ঋণ বাড়ার অর্থ সবসময় ভাল খবর নয়। অতীতের অভিজ্ঞতাও তাই। আজকের দিনেও এমন হতে পারে। যদি সত্যি সত্যি অকারণে ঋণ বৃদ্ধি ঘটে থাকে, তাহলে এই টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন হবে। ‘রিসিডিউলিং’ হবে, ‘রিস্ট্রাকচারিং’ হবে কোনদিন টাকা ফেরত আসবে না। এমতাবস্থায় ঋণ বৃদ্ধির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে। আমার ধারণা ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির হার খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। সমূহ বিপদে পড়বে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। এখনই সাবধান হওয়া দরকার। বড় ঋণগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। অবশ্য পেছনের লোক যদি হয় ‘হস্তিসম’ তাহলে ‘পিপিলিকাসম’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি করতে পারবে? ভরসা পাই না। অবস্থা দৃষ্টেই এই উপলব্ধি। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×