ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

সজীব ওয়াজেদ জয় এবং পুলিশের জরুরী সেবা ৯৯৯

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

সজীব ওয়াজেদ জয় এবং পুলিশের জরুরী সেবা ৯৯৯

পুলিশ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানসহ জরুরী সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সেবা গ্রহণের সুবিধা চালু করেছে। গত এক বছর ধরে এই ব্যবস্থাটি পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করে মঙ্গলবার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। এই ব্যবস্থার অধীনে এখন থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে বা দমকল বাহিনী অথবা এ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে যে কোন ফোন থেকে ৯৯৯ নম্বরে কল করা মাত্র পুলিশসহ জরুরী বিভাগ সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগীর কাছে পৌঁছে যাবে। বলা হয়েছে যে, ৯৯৯ নম্বরে কল গ্রহণ করার পর সাত মিনিটের মধ্যে সেই সেবা ঘটনা স্থলে পৌঁছাবে। উদ্যোগটি খুবই প্রয়োজনীয়, সময়োপযোগী এবং প্রশংসার দাবি রাখে। যদি এই উদ্যোগের অর্ধেকও বাস্তবায়ন বা কার্যকর করা সম্ভব হয় তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সন্তোষজনক উন্নতি ঘটবে। এই পদ্ধতি আমাদের দেশে নতুন বা অভিনব মনে হলেও উন্নত দেশগুলোতে এটি খুবই অত্যাবশ্যকীয় জরুরী সেবা প্রদান ব্যবস্থা। বিশেষ করে আমেরিকা-কানাডাতে এই রকম ৯১১ নামের জরুরী সেবা খুবই পুরনো এবং বেশ জনপ্রিয়ও বটে। এখানে যে কোন ধরনের জরুরী সেবা বিশেষ করে পুলিশ, ফায়ার বা এ্যাম্বুলেন্সের সহযোগিতা নিতে চাইলে জনগণকে এই ৯১১ নম্বরে ফোন করতে হয়। এখানে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং ৯১১ নম্বর একাকার হয়ে আছে। ঠিক আমেরিকা-কানাডার ৯১১ নম্বরের আদলে বাংলাদেশেও ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে সেবা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের নিজস্ব ধারণা এবং প্রচেষ্টা থেকেই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জরুরী সেবা প্রদান ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়েছে। সজীব ওয়াজেদ জয় নিজে একজন দক্ষ ও স্বনামধন্য তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং উত্তর আমেরিকা তথা আমেরিকা-কানাডায় প্রচলিত অনেক নিয়ম-পদ্ধতি তার নখদর্পণে। এখানে প্রচলিত ভাল কিছু নিয়ম-পদ্ধতি যা খুব সহজে এবং স্বল্প বিনিয়োগে আমাদের দেশে প্রচলন করা যায়। সেটাই বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। ফলে বাংলাদেশ খুব দ্রুত ডিজিটাল যুগে এগিয়ে চলছে এবং বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগ অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বে¡ও ৯১১-এর আদলে ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে সেবা প্রদান ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। এটি অবশ্যই আশার কথা এবং আমরা এই উদ্যোগের শতভাগ সফলতা কামনা করি। ৯১১-এর মতো এরকম তিন সংখ্যার বিশেষ কোন নম্বরের মাধ্যমে জরুরী সেবা প্রদানের ব্যবস্থা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ব্যতীত অন্য কোন দেশে খুব একটা দেখা যায় না। কারণ এ জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট সম্পদ, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। ৯১১ নম্বরের আদলে ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে সেবা প্রদানের উদ্যোগ আমাদের দেশে সফলভাবে বাস্তবায়ন ও কার্যকর করতে হলে যথেষ্ট সম্পদ, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এই সেবাটি সম্পূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে আমেরিকা কানাডায় এই ধরনের সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রতিটা ফোন নম্বরে বিশেষ জিপিএস থাকে, যা শুধু পুলিশের এই ৯১১ নম্বরের ব্যবহারের জন্য প্রযোজ্য। কোন ফোন থেকে ৯১১ নম্বরে কল করা মাত্র সেই ফোনের জিপিএস বা ল্যান্ডফোনের ঠিকানার ডাটাবেজের মাধ্যমে সেই অকারেন্স স্পট নিশ্চিত করে সেখানে পৌঁছার রোডম্যাপ পুলিশের কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠে, যা পুলিশকে বা জরুরী সেবা প্রদানকারীদের সেই স্থানে দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দিতে পারে। ফোন, ল্যান্ডফোনের ঠিকানার ডাটাবেজ, জিপিএস এবং পুলিশের যানবাহনে স্থাপিত কম্পিউটার সংযোজন করে সমন্বিত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এই ধরনের অত্যাধুনিক ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে সেবা প্রদান ব্যবস্থা সফল করে তোলা কষ্টকর হবে। কথাগুলো এ কারণে গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশে এখনও সব মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ঠিকানা যেখানে নিশ্চিত নয়, সেখানে তাদের পাঠানো ৯৯৯ নম্বরের কলে কিভাবে পুলিশ বা জরুরী বিভাগ সেবা দিবে। এসব উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকা-কানাডাতে ৯১১ নম্বরে ফোন গৃহীত হওয়ার মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে পুলিশ, ফায়ার এবং এ্যাম্বুলেন্সের ঘটনাস্থলে পৌঁছার বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং সে অনুযায়ী পুলিশ প্যাট্রোলের ব্যবস্থা করা আছে। তদুপরি সকল মহাসড়কে পুলিশসহ জরুরী বিভাগের গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত লেন আছে যেখান দিয়ে সেসব গাড়ি অনায়াসে এবং নির্বিঘেœ যেতে পারে। তাছাড়া পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং এ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি দেখা মাত্র সকল যানবাহন গতি থামিয়ে বা সাইডে দাঁড়িয়ে তাদের জায়গা করে দেয়, কারণ তা করতে ব্যর্থ হলে ভাল অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়। এসব কারণে এখানে পুলিশ সময়মতো জরুরী সেবা প্রদান করতে সক্ষম হয়। তারপরও অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছাতে বিলম্ব হয়। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে তুষার ঝড়ের সময় বা কোন কারণে ৯১১ নম্বরে প্রাপ্ত কলের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হলে পুলিশ সব কলে সাড়া দিতে পারে না। এ কথা পুলিশ বিভাগ থেকে স্পষ্ট জানিয়েও দেয়া হয় যে, পুলিশের পক্ষে সব কলে সাড়া দেয়া সম্ভব নয়। নাগরিকরা নিজেরা যেন সাবধান ও সতর্ক থাকে। পুলিশের এমন মন্তব্য নিয়ে এসব দেশে তেমন কোন উচ্চবাচ্য হয় না, কারণ জনগণ এখানে অনেক বেশি সচেতন এবং বাস্তবতাটা ভালভাবেই বোঝে। এ রকম মন্তব্য আমাদের দেশের কোন পুলিশ কর্মকর্তা করলে জনগণ কিছু না বললেও মিডিয়ায় এমন ঝড় উঠবে এবং তথাকথিত টকশোগুলোতে এমন হৈচৈ পড়ে যাবে তাতে পুলিশ প্রধান কেন, হয়ত সরকারেরই পতন ঘটে যাওয়ার উপক্রম হবে। তাছাড়া আমাদের দেশে জনসংখ্যা এবং পুলিশ ও জরুরী সেবা প্রদানকারী সংস্থার অনুপাত এতই নগণ্য যে, কোনভাবেই পুলিশের পেট্রোল সেভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, ফলে এই ধরনের জরুরী সেবা প্রদান করা কষ্টকর হয়ে উঠবে। অধিকন্তু আমাদের দেশে ট্রাফিক একটি মারাত্মক সমস্যা, যা এই সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। পুলিশ বা জরুরী সেবার গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত লেনের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি সেই গাড়িকে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার মতো মানসিকতা বা অবস্থা আমাদের দেশে একেবারেই নেই এবং এ জন্য বিশাল জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থাও নেই। এহেন পরিস্থিতিতে অসহায় পুলিশ, দমকল বা এ্যাম্বুলেন্স কিভাবে ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করবে সেটাই ভাবনার বিষয়। সেইসঙ্গে জরুরী সেবার সংজ্ঞাও পূর্ব থেকে সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। অর্থাৎ কোন ধরনের বিপদে পড়লে এই ৯৯৯ নম্বরে কল করে সাহায্য পাওয়া যাবে তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। বিনা কারণে কেউ এই ৯৯৯ নম্বরে কল করলে জরিমানা প্রদানের বিধান রাখতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে যে কেউ কারণে-অকারণে এই নম্বরে ফোন করবে এবং এই ব্যবস্থার অপব্যবহার করার সুযোগ পাবে। এমনিতেই এই পদ্ধতিতে যথেষ্ট অপব্যবহার বা অপ্রয়োজনীয় কলের সুযোগ রয়েছে। এমনকি আমেরিকা-কানাডাতেও এই ৯১১ নম্বরে ভুয়া বা অপ্রয়োজনীয় কলের জন্য কঠোর জরিমানার বিধান থাকা সত্ত্বেও এখানে যথেচ্ছ ভুয়া বা অপ্রয়োজনীয় ৯১১ কল হয়ে থাকে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি উদ্যোগটি নিঃসন্দেহ প্রশংসনীয় এবং বর্তমান সময়ে খুবই জরুরী। তবে উন্নত বিশ্বের মতো অত্যাধুনিক সেবা আমাদের মতো অনুন্নত দেশে চালু করতে গিয়ে যেন লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সর্তক দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। যে কোন ব্যবস্থা শুরুর দিকে অনেক সমস্যা থাকে এবং অনেক ভুলত্রুটির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। বেশ কিছুদিন চলার পর সেই ব্যবস্থা একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রা পায়। সে পর্যন্ত জনগণকে যেমন ধৈর্য ধরতে হয়, তেমনি সমাজের সকল পক্ষকে সহযোগিতা করতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে. এই সহনশীলতা এবং সহযোগিতার বড়ই অভাব আমাদের দেশে। বিশেষ করে মিডিয়া এবং টেলিভিশন টকশোর কিছু বিজ্ঞ (?) আলোচক তো পুরোপুরি নেতিবাচক। যদি এই ৯৯৯ নম্বরের জরুরী সেবার মাধ্যমে ৮০ শতাংশ সফলতা পায় এবং বাকি ২০ শতাংশ ব্যর্থ হয় তাহলে দেখা যাবে মিডিয়া ও টেলিভিশনের টকশোর সেই সকল আলোচক সফল আশি শতাংশ নিয়ে টু শব্দটিও করবে না; কিন্তু বিশ শতাংশের ব্যর্থতা নিয়ে দেশের পুলিশ বিভাগ ও সরকার তুলাধুনা করবে। কয়েক বছর আগে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে কমিউটার ট্রেন চালু করার সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সেই ট্রেনের যত সব খারাপ দিক নিয়ে, যেমন এসি কাজ করে না, দাঁড়িয়ে যেতে হয় প্রভৃতি উল্লেখ করে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অথচ এ কথা কেউ বলছে না যে, গণপরিবহনের ভাঙ্গাচুরা বাসে চেপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার চেয়ে এই ট্রেন অনেক ভাল। এমন যেখানে দেশের সামাজিক ব্যবস্থা সেখানে অত্যাধুনিক ৯৯৯ নম্বরের সেবা প্রদানের উদ্যোগ সফল করে তোলা মূলত একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলা করতে হলে এই পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত সীমাবদ্ধতাগুলো খতিয়ে দেখে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। দেশ যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে চলছে তাতে এমন সেবার বিকল্প নেই। এই উদ্যোগটি সফল হলে আমেরিকা-কানাডায় প্রচলিত অনেক উন্নত পদ্ধতি আমাদের দেশেও সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে চালু হবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা [email protected]
×