ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বর্ণাঢ্য মঞ্চায়ণ

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭

বর্ণাঢ্য মঞ্চায়ণ

মলয় বিকাশ দেবনাথ ॥ ‘আমরা ফুরিয়ে যাই তোমাদের তরে অফুরান হতে’ মুক্তিযুদ্ধের আত্মোৎসর্গের ইতিহাস ও মহিমাকে ইঙ্গিত করে শুরু হলো ১২তম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় নাট্যোৎসব ২০১৭। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বিজয়ের মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরমেন্স বিভাগের আয়োজনে বিগত ১১ বছরের ধারাবাহিকতায় গত ১১ ডিসেম্বর উৎসবের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় নাট্যব্যক্তিত্ব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. আহমেদুল কবির। উৎসবে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয় প্রখ্যাত অভিনেতা, নির্দেশক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আলী যাকেরকে। যুগ যুগ ধরে শিল্প সাহিত্য যেভাবে মানুষকে বাঁচার প্রেরণা যুগিয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় শিল্পী সমাজ শিল্পকে ধরে রাখতে ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করতে নানাভাবে শিল্পচর্চা অব্যাহত রেখেছে। মঞ্চনাটক শিল্পের একটি অন্যতম অংশ। আজ আমাদের দেশে সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রƒফেশনাল কোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যার ফলে নাটক হয়ে উঠেছে আরও সমৃদ্ধ। নাটক নিয়ে শুরু হয়েছে গবেষণা। টেকনিক্যাল দিকগুলোতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। ঐতিহ্যবাহী নানান সংস্কৃতি যুক্ত হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে। সর্বোপরি একটি বিপ্লব ঘটতে চলেছে এই মঞ্চনাটক চর্চায়। এর প্রত্যক্ষ ফল শিল্পে প্রতীয়মান হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এই সফলতা হবে গগনচুম্বী। মানুষ মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও প্রেম-ভালবাসার সুস্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয় মঞ্চায়নগুলোতে যা সমাজের অস্থিরতা দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তরুণ সমাজ আকৃষ্ট হচ্ছে মঞ্চের দিকে। বিভিন্ন সচেতনতামূলক পথনাটক হচ্ছে যা হতে তরুণ সমাজ অন্ধকার জগত হতে ফিরতে চলেছে। এখন দরকার উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারী সহায়তায় দূর করতে হবে মঞ্চের অপ্রতুলতা। ৮ দিনব্যাপী নাট্যোৎসবে উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চ-ালিকা’ দিয়ে। সাদিয়া মাহবুব সারার নির্দেশনায় ধর্মের বৈষম্য ও জাতপাতের ভেদাভেদ অর্থাৎ কবি গরুর চিন্তা-চেতনা সহজ ও সাবলীলভাবে মঞ্চে ফুটে উঠেছে। ২য় প্রদর্শনী ছিল মনিরুজ্জামান রিপনের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় সৈয়দ শামসুল হকের ‘নীলদংশন’। চলমান এই নাট্যোৎসব যেন শুধু নাটক মঞ্চায়নই নয় এ যেন এক মহা সম্মিলন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ সহ অনেক শিল্পী-কলাকুশলীর উপস্থিতিতে যেন টিএসসি হয়ে উঠেছে মহা মিলনমেলা। ১২ ডিসেম্বর আহমদ ছফার উপন্যাস অবলম্বনে রিয়াজ তারেকের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় মরণ বিলাস। শ্লেøষ, পরিহাস, ব্যঙ্গ ও বাগবৈদগ্ধের মাধ্যমে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়ানো মন্ত্রী ফজলে এলাহী ও হাসপাতালে সেবারত তার চেলা মওলা বক্সের এক অন্তিম রাত্রির আখ্যান ছিল নাটকের উপজীব্য বিষয়। একই দিনে মারিয়া খনম মিমের নির্দেশনায় বাদল সরকারের ‘বাঘ’ ও মোঃ এহসানুল আবেদীনের নির্দেশনায় পল হাওয়ার্ড স্যুরিজের নাটক ‘উদ্যোক্তা মন’ মঞ্চায়িত হয়। যে কোন অনুষ্ঠান মানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রাণবন্তভাবে উদযাপন করার চেষ্টা করে। পড়াশোনার পাশাপাশি এই নাট্যোৎসব যেন তাদের একঘেয়ে জীবন থেকে একটু প্রশান্তি যোগায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত উজানে মৃত্যু পরিবেশিত হয় সজীব রানার নির্দেশনায়। একই দিনে আবদুল্লাহ আর জাবিরের নির্দেশনায় সফল মঞ্চায়ন হয় আগস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের নাটক ‘মিসজুলি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই ডিসেম্বর মাসের জন্য। সপ্তাহব্যাপী নাট্যোৎসবে মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে দুটি করে নাটক দেখার সুযোগ সত্যি লোভনীয়। আজ পরিবেশিত হবে বুদ্ধদেব বসুর নাটক ‘বিশ বছর আগে অথবা পরে’। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন আরেক মেধাবী নির্দেশক প্রণব শর্মা। দিনের পরবর্তী নাটক ট্রেডর সুথার্সের ‘ক্ষরণ’। অনুবাদ, নির্দেশনায় রয়েছেন এসএম লতিফুল খাবীর। আগামী দর্শকদের জ্ঞাতার্থে ১৫ ডিসেম্বর কাজী নজরুল ইসলামের ‘শিল্পী’ নাটকের নির্দেশক হিসেবে রয়েছেন তামান্না ইসলাম এবং অন্য নাটক রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’, নির্দেশনায় রয়েছেন রফিকুল ইসলাম সবুজ। এ ছাড়া আগামী ১৬, ১৭ ও ১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে যথাক্রমে মোঃ আশরাফুল আলমের নির্দেশনায় ‘মাইক মাস্টার’ নাছুমা হকের নির্দেশনায় ‘তৃতীয় পুরুষ’, মোঃ শামীম মিয়ার পরিচালনায় হ্যারলন্ড পিন্টারের ‘ডাম্ব ওয়েটার’, নুসরাত জাহানের নির্দেশনায় ‘অলৌকিক রন্ধন প্রণালী’, ‘তারাবিবির মরদপোলা’ নাটকের নির্দেশনায় আছেন রাগীব নাইম এবং মমতাজ উদ্দীন আহমদের রচিত ও কীর্তি বিজয়ার নির্দেশনায় নাটক ‘কী চাহ শঙ্খচিল’ এর মধ্য দিয়ে নাট্যোৎসবের পর্দা নামবে। এই নাট্যোৎসব হোক মঞ্চনাটকের বিপ্লবের ধারাবাহিকতা। জয়তু নাট্যোৎসব ২০১৭।
×