ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং চলচ্চিত্র

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং চলচ্চিত্র

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই মহৎকর্মের রেশ কিন্তু শুরু হয়েছিল সেই (১৯৪৭ সালের) দেশভাগের কিছুকাল পরেই। যখন আমরা দেখতে পেলাম এবং অনুভব করতে শুরু করলাম এই সুবিশাল উপমহাদেশটি রাতারাতি টুকরো হওয়াতে আমাদের অর্থাৎ বাঙালী জাতির মহাক্ষতি হয়ে গিয়েছে। তখন থেকে, আমরা এক রকম পাপ মোচনের দায়মুক্তির লক্ষ্যে খুব সচেতন হয়ে উঠলাম! আমাদের চেতনায় দিকে দিকে জেগে উঠতে থাকল হাজার বছরের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-ভাষা ইত্যাদি ইত্যাদি। পৃৃথিবীর মানচিত্রে খুবই বিরল হয়ে দাঁড়াল আামদের ভৌগোলিক অবস্থান। এসব কোনভাবেই আমরা মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। অবশেষে প্রতিবাদ করা হয়ে ওঠে আমাদের জন্য বেঁচে থাকার, টিকে থাকার একমাত্র অনুষঙ্গ! অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতে আমরা একসময় পৌঁচ্ছে গেলাম সংগ্রামের চূড়ান্তপর্বে। প্রতিদান হিসেবে দিতে হলো লাখ লাখ অমূল্যপ্রাণ! এক নদী রক্তে স্থান করে বাংলার বুকে উদিত হয় স্বাধীনতা নামের রাঙ্গাসূর্য! আমরা স্বাধীনতা নামক অমৃতের স্বাদ পেলাম। প্রতিষ্ঠিত হলো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জাতীয়তাবাদ এবং নিজেদের দীর্ঘ দিনের লালিত অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আসলে এসব প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য, এর জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংগ্রামের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল অনিবার্য। ১৯৭১ সালে জতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন অস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছুরই যুদ্ধ আমাদের করতে হয়। কণ্ঠের যুদ্ধ, কবিতার যুদ্ধ, চলচ্চিত্রের যুদ্ধ সমানে চলতে থাকে রণাঙ্গনের বাইরে। আসলে অস্ত্রের বাইরে যে যুদ্ধ বাঙালী করেছিল তা কেবলই মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে নয়। একাধিক আলাদা আলাদা চেতনা থেকে, অবশ্য যুদ্ধ শুরুর আগেই আমরা এসব স্পষ্ট করেছি। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের স্বাধিকার আদায় করেছি। নতুন দেশে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয় দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। এর মধ্যে চলচ্চিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একসময় আমাদের চলচ্চিত্রকাররা প্রাণের গভীরে স্বপ্ন দেখতেন একদিন তারা নির্মাণ করবেন মুক্তচিন্তার চলচ্চিত্র। যদিও সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা ছিল প্রবল। তার পরও জহির রায়হান, আলমগীর কবির, ফখরুল আলম, বুলবুল চৌধুরীরা প্রাণ হতে রেখে নির্মাণ করেছেন সিনেমা। পাশাপাশি ‘স্টপ জেনোসাইড’ ‘ইননোসেন্ট মিলিয়ান্স’ ‘লিবারেশন ফাইটার’ ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ ছিল অসাধারণ সব প্রামাণ্যচিত্র। এগুলো ধারণ করা হয়েছিলেন কঠিন যুদ্ধকালীন সময়ে। তৎক্ষণাৎ এসব প্রামাণ্যচিত্র তারা পৌঁচ্ছেও দিয়েছিলেন বিশ্ববিবেকের দরবারে । মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র জহির রায়হান গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনে ’৫২-এর চেতনায় নির্মাণ করেছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ প্রায় কাছাকাছি সময় ফখরুল আলম নির্মাণ করেন ‘জয় বাংলা’ নামে আরও একটি সিনেমা। তৎকালীন শাসক এই সিনেমা দুটি সেন্সরে আটকে দেয়। পরবর্তীতে জনগণের আন্দোলনের মুখে ’৭০ সালে মুক্তি পায় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। কিন্তু ‘জয় বাংলা’র মুক্তির জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ‘ওরা ১১ জন’ ‘অরুণোদয়ের অগ্নি সাক্ষী’ ‘বাঘা বাঙালী’ ‘রক্তাক্ত বাংলা’ নামে চারটা মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। একই দশকে মুক্তি পায় আরও আট চলচ্চিত্র। এ গুলোর মধ্যে ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ‘সংগ্রাম’ ‘আলোর মিছিল’ ‘মেঘের অনেক রং’ উল্লেখযোগ্য। এর পর আশির দশকে এই চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল খুবই কম তারমধ্যে ‘কলমীলতা’ ‘বাঁধন হারা’ ছিল উল্লেখ্য। নব্বইয়ের দশকে নির্মিত হয় প্রায় দশটি সিনেমা। এর মধ্যে ‘নদীর নাম মধুমতি’ ‘আগুনের পরশমণি’ ‘মুক্তির গান’ হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ এবং মুক্তির কথা উল্লেখযোগ্য। নতুন শতাব্দীতেও নির্মিত হয় এবং হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা। কিন্তু একটু আলদা করে যদি দেখি তাহলে, দেখা যায় প্রায় সব সিনেমায় কেবল যুদ্ধই দেখানো হয়েছে। সিনেমার গল্পে শত্রু পক্ষের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই বিষয়টাই বেশিরভাগ সিনেমায় মুখ্য! কিন্তু আমরা কি কি কারণে যুদ্ধ করলাম, স্বাধীন হলাম। আমাদের দার্শনিক ভিত্তি কি ছিল। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আমাদের দর্শন কোথায় গিয়ে দাঁড়াল; এমন সব জতিগত মনস্তাত্ত্বিক চেতনায় আদৌ কি কোন সিনেমা নির্মিত হয়েছে বা হচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ যদি চেষ্টা করে থাকেন তাদের মধ্যে আলগীর কবীর পরবর্তীতে নারায়ণ ঘোষ মিতা হুমায়ূন আহমেদ, তানভির মোক্কামেল, তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলামরা আংশিক চেষ্টা করলেও মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনার গল্পের সিনেমা নির্মাণের চেষ্টা খুব কম দেখা গিয়েছে। তবে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঙালীর চেতনার ভাবাবেগ কালে কালে কত যে পরিবর্তিত হয়েছে তার একটা আংশিক চিত্র দেখা গিয়েছে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রে। বিশেষ করে তাঁর ‘মাটির ময়না’ ছিল অনন্য। আলাদা করে সমসাময়িক সিনেমার নাম উল্লেখ করলে তা কেবল বাহুল্যই হবে কারণ বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের বিষয় এক। আসলে বেশিরভাগ সিনেমায় দেখানোই হয়েছে যুদ্ধকালীন সময়টাকে। অবশ্যই চলচ্চিত্রে যুদ্ধকালীন গল্প ভীষণ গুরুত্বের কিন্তু, এর পেছনের সময় এবং প্রেরণার গল্পও তো সমান গুরুত্বের! সুতরাং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে এই বিষয়গুলো সমান গুরুত্ব নিয়ে থাকা উচিত ছিল বৈকি?
×