ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্ত্রীকে আত্মঘাতী তৈরির চেষ্টা করেছিল নিউইয়র্কের এ বোমা হামলাকারী

আমেরিকায় যাবার পরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে আকায়েদ

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭

আমেরিকায় যাবার পরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে আকায়েদ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আমেরিকায় যাওয়ার পর জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে নিউইয়র্কে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বাংলাদেশী জঙ্গী আকায়েদ উল্লাহ। তার জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে এক বাংলাদেশী ঠিকাদার জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই ঠিকাদার বর্তমানে দুবাই রয়েছেন। ওই ঠিকাদারকে আটকের চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে আকায়েদের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার কোন তথ্য মেলেনি। পুরোপুরি আত্মঘাতী জঙ্গী হওয়ার পর আকায়েদ পরিবারের সবাইকে জঙ্গীবাদের দিকে টানার চেষ্টা করেছিল। প্রথমেই টার্গেট করেছিল স্ত্রীকে। তারই অংশ হিসেবে স্ত্রীকে পুরোপুরি জঙ্গীবাদে দীক্ষিত করতে সে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তাত্ত্বিক গুরু মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীর ধর্মীয়বিষয়ক অডিও শোনাতো। আকায়েদ আগে থেকেই জঙ্গী কি না এবং তার অতীত ইতিহাস সর্ম্পকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে। দেশে আকায়েদের বিরুদ্ধে কোন সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর রেকর্ড নেই বলে বাংলাদেশের তরফ থেকে আমেরিকা সরকারকে জানানো হয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর সকালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের কাছে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। দগ্ধ অবস্থায় বাংলাদেশী যুবক আকায়েদ উল্লাহ গ্রেফতার হয়। বুধবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, আকায়েদ উল্লাহর দেশে জঙ্গী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার কোন তথ্য মেলেনি। এমনকি এদেশের কোন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে আকায়েদের যোগাযোগ থাকারও তথ্য পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর ইন্টারনেটের মাধ্যমে আকায়েদ জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। একপর্যায়ে আকায়েদ আত্মঘাতী জঙ্গী হয়। আকায়েদ জঙ্গী হওয়ার পর জঙ্গী সংগঠনগুলোর নিয়মানুযায়ী সে পরিবারের সদস্যদেরও জঙ্গীবাদের দিকে টানার টার্গেট করে। তারই ধারাবাহিক আকায়েদ সম্ভবত প্রথম টার্গেট করে স্ত্রীকে। আকায়েদ স্ত্রীকে জঙ্গীবাদে উদ্ধুদ্ধ করতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তাত্ত্বিক নেতা মুফতি মাওলানা জসিমউদ্দিন রাহমানীর অডিও লেকচার শুনাতেন। আকায়েদের শ্যালক হাফিজ মাহমুদ জয়কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আকায়েদের পরিবার সদস্যদের আবারও ডাকা হবে। আকায়েদকে আমেরিকায় চাকরিদাতা বাংলাদেশী ঠিকাদার সর্ম্পকে জানার চেষ্টা চলছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট আকায়েদের চাচাতো ভাই আব্দুল আহাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, আকায়েদ ধানমন্ডি কাকলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। পিলখানাস্থ মুন্সী আবদুর রউফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ (বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুল অ্যান্ড কলেজ) ও ঢাকা সিটি কলেজে পড়াশোনা করেছে। ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় ২০১১ সালে সে তার ভাই-বোনদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চলে যায়। ঢাকা সিটি কলেজে বিবিএ পড়ছিল। পড়াশুনারত অবস্থায়ই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। ২০১৩ সালে নিউইয়র্কে পিতার মৃত্যুর পর আকায়েদ পুরোপুরি ধার্মিক হয়ে যায়। এরপর আস্তে আস্তে আকায়েদ পাল্টে যেতে থাকে। জানা গেছে, আকায়েদ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আকায়েদের বক্তব্য রেকর্ড করেছে নিউইয়র্ক পুলিশ। নিউইয়র্ক পুলিশ বলছে, ২০১১ সালে ফ্যামিলি ভিসায় আকায়েদ আমেরিকায় যায়। ২০১২ সালের মার্চ থেকে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত লিমোজিন বা ব্ল্যাক ক্যাব চালানোর লাইসেন্স ছিল আকায়েদের। পরে তিনি আর তা নবায়ন করেননি। পরে পেশা পরিবর্তন করে একটি আবাসন নির্মাতা কোম্পানির বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির চাকরি নেন। ব্রুকলিনের এ্যাপার্টমেন্টে বসে ইন্টারনেট ঘেঁটে বোমা বানানো শেখেন। ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজের সূত্রে কর্মস্থলে বসেই বোমা তৈরি করতো। আকায়েদের দেয়া বক্তব্যের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক পুলিশের কমিশনার জেমস ওনিল জানান, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেয়ায় ক্ষোভ থেকে আকায়েদ নিজের তৈরি বোমা নিজের শরীরে বেঁধে আত্মঘাতী হামলা চালায়। বোমাটি ঠিকমত বিস্ফোরিত না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হয় আকায়েদ। বিস্ফোরণে তিন পুলিশও আহত হন। আকায়েদ আইএস দ্বারা অনুপ্রাণিত। তবে আইএসের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকার কোন তথ্য মেলেনি। নিউইয়র্কে থাকা আকায়েদের এক ভাই, বোন ও মাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্ত কর্মকর্তারা। আকায়েদ মসজিদে যাতায়াত করলেও কারও সঙ্গে মিশতো না। দেশে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ-সংগঠন ছাত্র শিবিরের রাজনীতি করলেও, নিউইয়র্কে জামায়াতে ইসলামীর অফিসে তেমন যাতায়াত ছিল না আকায়েদের। নিউইয়র্ক প্রবাসী এক বাংলাদেশী ঠিকাদারের অধীনে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করতেন আকায়েদ। ওই ঠিকাদার বর্তমানে দুবাই রয়েছেন। তাকে আটকের চেষ্টা চলছে। এমন ঘটনার পর মঙ্গলবার রাজধানীর জিগাতলার মনেশ্বর রোডের বাসা থেকে আকায়েদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জুঁই (২৪), আকায়েদের শ্বশুর জুলফিকার হায়দার ও শাশুড়ি মাহফুজাকে জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, ২৭ বছর বয়সী আকায়েদ আমেরিকায় জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে বলে জানা গেছে। দেশে থাকতেই আকায়েদ উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার মূসাপুর ইউনিয়নের ভুটান বা বোতান তালুকদার বাড়িতে। গত বছরের জানুয়ারিতে জান্নাতুল ফেরদৌস জুঁইয়ের সঙ্গে আকায়েদের বিয়ে হয়। চলতি বছরের ১০ জুন আকায়েদ সন্তানের জনক হয়। সন্তান হওয়ার পর চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর দেশে এসেছিল আকায়েদ। মাসখানেক অবস্থানের পর ২২ অক্টোবর সে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যায়। আকায়েদ দেশে থাকার সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। আকায়েদের চাচাতো ভাই সোহরাব জানান, আকায়েদের পিতার নাম সানাউল্লাহ (বীর মুক্তিযোদ্ধা)। তারা ঢাকার হাজারীবাগে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। একটি মুদি দোকান ছিল। আকায়েদের পিতা নোয়াখালীর সাবেক এমপি ওবায়দুল হকের ভায়রা। তার মাধ্যমেই আকায়েদরা আমেরিকায় চলে যান। চার ভাই-বোনের মধ্যে আকায়েদ সবার বড়। নিজে এবং এক বোনের বিয়ে হয়েছে চাঁদপুরে।
×