ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী নির্বাচনে বামপন্থীরা কী করবেন? -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭

আগামী নির্বাচনে বামপন্থীরা কী করবেন? -স্বদেশ রায়

সম্প্রতি আসিফ নজরুল মন্তব্য করেছেন ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা উচিত। আসিফ নজরুলের এ মন্তব্যের পর নিজের থেকেই বিএনপি সমর্থক, নেতা ও কর্মী, বন্ধুবান্ধব এবং সাংবাদিকতার সূত্রে যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। তাঁদের ভেতর দুইজনের কথা ২০১৯-এ আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা উচিত। এর ভেতর একজন জেলা পর্যায়ের নেতা। তাঁর জেলাকে ২০১২-১৩ সালে জামায়াত-বিএনপি একটি মিনি পাকিস্তান বানিয়েছিল। কোন কোন গ্রামে তারা পাকিস্তানের পতাকাও তুলেছিল। ওই এলাকার এই বিএনপি নেতা (তাঁদের পরিবার এখনও কম-বেশি জামায়াত ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট) উচ্চশিক্ষিত এবং বেশ বিনয়ী ভদ্রলোক। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর এলাকায় এখন নির্বাচন হলে কী হবে? তিনি বললেন, এখনও ঠিক বোঝার সময় হয়নি- কারণ নির্বাচনের আগে বিএনপি কতটুকু শক্তিশালী হবে না আরও দুর্বল হবে তার ওপর নির্ভর করছে। এই নিয়ে নির্বাচনের নানান কথা প্রসঙ্গে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি আর না করি, তিনি মনের থেকে চান আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। তাঁর মুখে এ কথা শুনে বিস্মিত হতেই তিনি বলেন, দেখেন আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা যেভাবে মানুষ হত্যা করবে তা ঠেকানোর ক্ষমতা বিএনপির নেই। আর ওই গণহত্যার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে বিএনপি চিরকালের মতো শেষ হয়ে যাবে। জেলা পর্যায়ের ওই নেতার মতোই তবে একটু আকার ইঙ্গিতে একই কথা বলেন সাবেক আওয়ামী লীগ কর্মী বর্তমানে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা। তিনি বলেন, আরও বছর পাঁচেক এভাবে গেলে জামায়াত শেষ হয়ে যাবে। তখন বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিএনপিও আওয়ামী লীগের মতো টানা ক্ষমতায় থাকতে পারবে। আওয়ামী লীগ তো একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল! বিএনপিরও একুশ বছর বাইরে থাকতে অসুবিধা কোথায়? আসিফ নজরুলের মতো যারা মডারেট ডানপন্থী তাঁরা নানানভাবে চাচ্ছেন বিএনপিকে যেন এই গণহত্যার দায় নিতে না হয়। আর এই গণহত্যা যে হবে এ নিয়ে শুধু মডারেট বিএনপি কেন, কারও ভেতর কোন সন্দেহ নেই। সম্প্রতি আমার এক বন্ধু, যিনি বামপন্থীদের সঙ্গে দেশের নানান স্বার্থ রক্ষার (তাঁদের বিবেচনা মতো) আন্দোলন করেন, তিনি এসেছিলেন আমার অফিসে। তাঁর ভেতর একটা চাপা ভয় দেখতে পেলাম। তিনি শুধু বার বার আমার মতামত জানতে চান যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে তো? আওয়ামী লীগের এমপি ও কর্মীরা নানান জায়গায় খারাপ কাজ করছে। এসব ত্রুটি থেকে বের হয়ে পারবে তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে? আমি তাঁকে হাসতে হাসতে বলি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে তো আপনাদের ভাল। আপনারা তো আওয়ামী লীগের বিরোধিতাই করেন। তাছাড়া আপনাদের ভাষায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই চরিত্রের। তাই আওয়ামী লীগের জায়গায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে আপনাদের অসুবিধা কোথায়? বন্ধু ভদ্রলোকও হাসতে হাসতে বললেন, বিষয়টি হাল্কা করবেন না, সিরিয়াসলি কথা বলুন। শ্রেণী চরিত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই। তারপরে তিনি আমার বিভিন্ন আড্ডায় বলা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভেতর পার্থক্য রেখার একটি উদাহরণ টেনে বললেন, আপনিই তো বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শ্রেণী চরিত্র এক হলেও বাস্তবে একটা পার্থক্য আছে। যেমন, কোন এক রাস্তায় কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে, সেখানে লোকের ভিড় জমে গেছে- আওয়ামী লীগের কোন ক্ষমতাসীন কেউ সে পথে হয়ত যাচ্ছেন, তিনি শুনলেন এক ধরনের গান হচ্ছে আর লোক ভিড় করেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কী করে ওখানে। একজন উত্তর দিল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাচ্ছে। খুবই ভাল গায়। আওয়ামী লীগার ভদ্রলোক হয়ত ওই গান শুনতে যাবেন না। শুধু বলবেন, আচ্ছা, গাইতে থাকুক। অন্যদিকে একজন বিএনপির ক্ষমতাশালী সে পথে যাচ্ছেন, তিনি বললেন, কী হচ্ছে ওখানে। কেউ একজন উত্তর দিল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে অর্ডার দিলেন। পিটিয়ে উঠিয়ে দাও ওদের। রাস্তার ওপর এসব কী! আমার এই আড্ডার উদাহরণটি টেনে তিনি বললেন, এই পার্থক্য তো বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভেতর আছে। আর যেখানে তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে দেয় না, সেখানে কি আমাদের গণসঙ্গীত গাইতে দেবে? বুঝতে পারলাম বিএনপি ক্ষমতায় আসে কিনা এই নিয়ে ভয় পাচ্ছেন বামপন্থীরা। তাই বন্ধু ভদ্রলোককে বললাম, ভয় পাচ্ছেন বিএনপিকে? তিনি বললেন, বিএনপির থেকেও বেশি ভয় এখন জামায়াতের। কারণ, জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি হয়েছে ঠিকই, তাদের কর্মীরা আছে। ছোট নেতারা আছে। আর এই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির প্রশ্নে আমরা বামপন্থীরা সোচ্চার ছিলাম বেশি (তাদের মতামত)। তাই বিএনপি ক্ষমতায় এলে জামায়াত তো প্রথম রাতেই বাংলাদেশকে বামপন্থী শূন্য করবে। ইন্দোনেশিয়ায় বা ইরানে যেভাবে বামপন্থীদের ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যা করা হয়েছিল, এমনকি তাদের আত্মীয়স্বজনকেও হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশে এবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাই হবে। আমি হাসতে হাসতে বলি, এত ভয় বামপন্থীদের পেলে হয়! বামপন্থার নীতিই তো হলো ওই অস্ত্র কেড়ে নিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করা। তবে এখানে অবশ্য আপনাদের অসুবিধা আছে। কারণ, জামায়াত যে অস্ত্র নিয়ে আসবে ওই অস্ত্র সম্পর্কে আপনাদের লিটারেচারে কোথাও কিছু লেখা নেই। কারণ, তারা আসবে গরু জবাই করা অস্ত্র নিয়ে। আর তা দিয়েই জবাই করবে। ভদ্রলোক এবার সোফার ভেতর একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপরে বললেন, এটাই সত্য। অন্তত কোটিখানেক মানুষ গোটা দেশে জবাই হবে। আমি হেসে বলি, ভারত তো কোরবানির পরে আমাদের গরুর চামড়া কেনে। এ চামড়া কি কিনবে? তিনি আবারও বিরক্ত হলেন, বললেন, আমি সিরিয়াস বিষয়কে হাল্কা করছি বার বার। এবার তাঁর মুখ দেখে আর হাল্কাভাবে কথা বলার সুযোগ থাকে না। তখন তাঁকে বলি, দেখুন আপনাদের বামপন্থীদের সমস্যা হলো, আপনারা থিসিস, এ্যান্টি থিসিস দিতে দিতে আসল কাজের সময় নষ্ট করে ফেলেন। যে কথা বামপন্থী হলেও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার তাঁর এক লেখায় লিখেছিলেন। যা এমনই, ‘আমরা যখন ঘরের ভেতর বসে থিসিস এ্যান্টি থিসিস নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সে সময়ে, শেখ মুজিব ম্যাচ (দিয়াশলাই) এবং কাগজের দাম উল্লেখ করে পূর্ব পাকিস্তানকে যে পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করছে সে কথা দেশের মানুষকে বুঝিয়ে মাঠ দখল করে ফেলেছে। তাই আমরা যখন মাঠে নামলাম তখন দেখি মাঠ শেখ মুজিবের দখলে।’ তাই আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের কী হবে সে কথা যখন আপনারা বুঝতে পেরেছেন, তখন দেশের মানুষকে সেটা বোঝান। নিজেরা ভয় পেয়ে তো লাভ নেই। যে কোন গণহত্যাকে সম্মিলিতভাবেই প্রতিরোধ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা থেকে নিয়ে বলা যায়, যার ভয়ে আপনারা ভীত তারা আপনাদের থেকে দুর্বল। আর শেখ হাসিনা তাদের আরও বেশি দুর্বল করে দিয়েছেন। তারা এখন প্রকাশ্যে মানুষের কাছে যেতে পারছে না। সেক্ষেত্রে আপনাদের সহস্রভাগ সুযোগ আছে। আপনারা রোডমার্চ করুন, সমাবেশ করুন, মিছিল করুন, মানুষ জাগরণের মঞ্চ করুন। সেখানে আপনারা বলেন, আগামী নির্বাচনে যে কোন মূল্যে বিএনপিকে ঠেকাতে হবে- তা না হলে গণহত্যা হবে। দেশের কোটি কোটি মানুষ নিহত হবে। রক্তের বন্যা বয়ে যাবে জামায়াতের প্রতিহিংসার চাপাতির কারণে। ভদ্রলোক বললেন, বাস্তবে আমাদের বামপন্থীদের একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখন। কারণ দেশের অন্যান্য স্বার্থ দেখাও যেমন আমাদের দায়িত্ব তেমনি দেশকে গণহত্যা থেকে বাঁচানোও আমাদের দায়িত্ব। তবে ভদ্রলোকের কথার ভেতর দিয়ে আরও একটি বিষয় বেরিয়ে এলো, বামপন্থীরা নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে পার্লামেন্টে যেতে চায়। পার্লামেন্টে তাদের দু-একজন প্রতিনিধি থাকুক এটাও তাঁরা চায়। বাস্তবতা হলো, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রগতিশীল বামপন্থীরা নতুন একটি সিদ্ধান্ত খুঁজছে। আমাদের উপমহাদেশের বামপন্থীরা কখনও সময়মতো সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পৃথিবী থেকে যখন বামপন্থা হারিয়ে যাচ্ছে, সে সময়ে বাংলাদেশের বামপন্থীরা যদি একটি সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয় নিশ্চয়ই সেটা পৃথিবীর জন্য উদাহরণ হবে। অন্যদিকে একটা সত্য সবাইকে মানতে হবে, বাংলাদেশের সমাজের মতো একটি পশ্চাদপদ সমাজে প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তি, তা তাঁরা যে নামেই থাকুক না কেন, তাঁদের টিকে থাকার দরকার আছে। কারণ আমাদের এই সমাজে অনেক প্রগতি বামপন্থীদের হাত ধরে এসেছে। [email protected]
×