ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রসিক নির্বাচন

মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘন থামছে না

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘন থামছে না

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ১২ ডিসেম্বর ॥ রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চলছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। নির্বাচন কমিশনের কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও আচরণবিধি লঙ্ঘন থামছে না। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে সোমবার পর্যন্ত জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে চারটি, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুটি এবং ছয় কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে একটি করে অভিযোগে অর্থদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী একজন মেয়র প্রার্থী নগরের ছয়টি এলাকায় ছয়টি নির্বাচনী অফিস স্থাপন করতে পারবেন। একজন কাউন্সিলর প্রার্থী তার ওয়ার্ডে একটি নির্বাচনী অফিস স্থাপন করতে পারবেন। কিন্তু প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তিনটি শীর্ষ রাজনৈতিক দলের মেয়র প্রার্থীরা এ বিধান মানছেন না। তারা প্রত্যেকেই প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিক অফিস স্থাপন করেছেন। আবার কাউন্সিলর প্রার্থীরাও একটি ওয়ার্ডে একাধিক অফিস স্থাপন করেছেন। সরেজমিন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ২৪ ও ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর চারটি করে মোট ৮টি অফিস স্থাপন করা হয়েছে। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থীর পক্ষে পাঁচটি অফিস স্থাপন করা হয়েছে। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী সুলতান আহমেদের আটটি নির্বাচনী অফিস স্থাপন করা হয়েছে। আবার পথসভা করতে গিয়ে অনেক সময় রাস্তা বন্ধ করে যান চলাচলের বিঘœ ঘটানো হচ্ছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু বলেন, আমরা নগরের ছয়টি এলাকায় ছয়টি নির্বাচনী অফিস স্থাপন করেছি। এর বাইরে উৎসাহী ভোটাররা নিজেদের বসার জন্য, রেস্ট নেয়া বা চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য নিজ দায়িত্বে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে নিজেদের বসার ব্যবস্থা করে থাকতে পারে। ওইগুলো নির্বাচনী অফিস নয়। ভোটের সময় এ রকম আড্ডা জমানোর জন্য ভোটাররা নিজেদের বসার ব্যবস্থা করতেই পারে। তিনি বলেন, রাস্তা বন্ধ করে পথসভা করা হয়নি। তবে পথসভায় অনেক সময় বেশিসংখ্যক মানুষ উপস্থিত হলে যান চলাচলের খানিকটা বিঘœ ঘটা স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে প্রার্থীর তো করার কিছু নেই। বেশি মানুষ পথসভায় যোগ দিলে তাদের তো তাড়িয়ে দেয়া যায় না। জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, আমরা ৩৩টি ওয়ার্ডে ৩৩টি নির্বাচনী অফিস করেছি। তবে কোন ওয়ার্ডে একাধিক অফিস স্থাপনের বিষয়টি সত্য নয়। স্থানীয় কর্মী-সমর্থকরা হয়ত নিজেদের বসার জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থা করে থাকতে পারেন। তিনি বলেন, আমরা রাস্তা বন্ধ করে পথসভা করতে চাই না। কিন্তু ভোটার যার বেশি তার পথসভায় দর্শকের উপস্থিতিও বেশি। উৎসাহী ভোটারদের উপস্থিতি বেড়ে গেলে পথসভা জনসভায় পরিণত হয়। কাজেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আচরণবিধি ভঙ্গ হয়। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের আসন্ন নির্বাচন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির জন্য একটি ‘মর্যাদার লড়াই’ হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দলের নেতাকর্মীরা ভাবছেন, এ নির্বাচন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। তাই নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে সব নির্বাচনী কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেও পড়েছেন প্রধান তিন দলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনী মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত জনমত জরিপে এগিয়ে আছে লাঙ্গল ও নৌকা। তৃতীয় অবস্থানে আছে ধানের শীষ। নির্বাচনী প্রচারের শুরুর দিকে ধানের শীষের অবস্থান শোচনীয় হলেও যতই ভোটের দিন এগিয়ে আসছে ততই ধানের শীষের পক্ষে ভোটার সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। এর পিছনে ২০ দলীয় জোটের ভোটারদের ভূমিকা আছে বলে মনে করা হচ্ছে। মেয়র পদে বিজয়ী হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। তার পক্ষে দলের নেতাকর্মীরা এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন। ভোটারদের মন জয় করতে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে তারা প্রচার চালাচ্ছেন। মহানগর লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি ম-ল বলেন, গত পাঁচ বছরে মেয়র ঝন্টু হাত দিয়ে রংপুরে যে উন্নয়ন হয়েছে তার কারণে ভোটাররা ঝন্টুকেই ভোট দিবে। সাধারণ ভোটারদের ‘এরশাদপ্রীতি’ এবার আর কাজ করবে না। তিনি বলেন, মানুষ চায় উন্নয়ন। আর উন্নয়ন চাইলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকেই ভোট দিবে জনগণ। মাঠ অনেকটাই নৌকার পক্ষে চলে এসেছে বলে তিনি দাবি করেন। রংপুর সিটি কর্পোরেশন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্বাচনী এলাকার মধ্যে অবস্থিত। সদর উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন নিয়ে রংপুর-৩ আসন। এ এলাকা লাঙ্গলের দুর্গ বলা হয়। লাঙ্গলের দুর্গে যাতে আর কারও অনুপ্রবেশ না ঘটে সে কারণে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চেয়ারম্যান এরশাদ ও তার দলের লোকেরা। এরশাদের ভাতিজা দলের সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব হোসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ সেই প্রচেষ্টায় বাগড়া দিয়েছেন। তিনি হাতী প্রতীক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় গত শুক্রবার আসিফকে দল থেকে বহিষ্কার করেছেন এরশাদ। বহিষ্কার হওয়ার পরও নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিনি মনে করেন লাঙ্গলের ভোট এবার হাতীতে পড়বে। তবে আসিফকে কোন ফ্যাক্টর মনে করছেন না জাপা প্রার্থী মোস্তফা। তিনি বলেন, রংপুরে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। এখানে মানুষ ভোট দেয় এরশাদকে আর লাঙ্গলে। এরশাদ যাকে সমর্থন করবেন, লাঙ্গল যার কাঁধে তুলে দিবেন, তিনিই বিজয়ী হবেন। এটাই রংপুরের বাস্তবতা। গত নির্বাচনে এরশাদের সমর্থন পাইনি, তাই নিজের জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও হেরেছি। এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ৭ মাস আগেই এরশাদ আমার কাঁধে লাঙ্গল তুলে দিয়েছেন। তার নির্দেশে জাপার সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লাঙ্গলের পক্ষে কাজ করছেন। কাজেই লাঙ্গলের জয় নিশ্চিত। এদিকে এবারের নির্বাচনে কাওসার জামান বাবলা দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় বিএনপিও নিজেদের মর্যাদার লড়াই হিসেবে দেখছে এ নির্বাচনকে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে তারা রংপুরে তাদের জনসমর্থনের পরীক্ষা চালাতে চায়। সেই সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের ঐক্য কতটা শক্তিশালী সেটাও প্রমাণ করতে চায়। ফলে দলটির নেতাকর্মীরা তার পক্ষে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। গত নির্বাচনে মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি কাওসার জামান বাবলা মেয়র পদে লড়লেও দলের নেতাকর্মীরা তার পাশে তেমন ছিলেন না। ভোটের ফলাফলে তার অবস্থান ছিল চার নম্বরে। বাবলা অভিযোগ করেন, আমার নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্নভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে। ঘরোয়া বৈঠকও করতে দিচ্ছে না প্রশাসন। নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি অকারণে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। যে কারণে আমি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ধানের শীষের জয় হবে বলে তিনি দাবি করেন। আগামী ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ৭ জন, ৩৩টি ওয়ার্ডে সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৫ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২১১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ওয়ার্ড আছে ৩৩টি। সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১১টি। তিন লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৬ পুরুষ এবং ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন নারী। গত ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্র ১৯৩টি, ভোটকক্ষ ১ হাজার ১১১২টি। ৩ হাজার ৬৫২ কর্মকর্তা এ নির্বাচনে কাজ করবেন। পাঁচ বছর আগে রংপুর সিটির ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪২ জন। গত ৪ ডিসেম্বর সোমবার দুপুরে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মোট ৭ মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু পেয়েছেন দলীয় প্রতীক নৌকা, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পেয়েছেন দলীয় প্রতীক লাঙ্গল, বিএনপি প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা পেয়েছেন দলীয় প্রতীক ধানের শীষ, জাপার বিদ্রোহী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হোসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ পেয়েছেন হাতি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের গোলাম মোস্তফা পেয়েছেন হাতপাখা, বাসদের আব্দুল কুদ্দুস পেয়েছেন মই ও এনপিপির সেলিম আক্তার পেয়েছেন আম মার্কা। এছাড়া সংরক্ষিত কাউন্সিল ৬৫ ও সাধারণ কাউন্সিলর ২১১ জন পদ প্রার্থীকেও প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
×