ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যারা ছিলেন ভোরের আলো;###;সাংবাদিক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আল বদররা তুলে নিয়ে যায় বিজয়ের আগ মুহূর্তেই

বাবা তাঁর প্রিয় সেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে যেতে পারেননি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

বাবা তাঁর প্রিয় সেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে যেতে পারেননি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘...৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে প্রকম্পিত হলো বাংলাদেশ। এ আন্দোলনের সময় প্রতিদিনই প্রায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ছাত্র জনতা নিহত হতে লাগল। বাবা ইত্তেফাকের পাতায় সে কাহিনী তুলে ধরতেন। স্বাধীনতাকামী বাঙালীর সঙ্গে এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরে ছিলেন অকুতোভয়ে। যার প্রমাণ অসহযোগ আন্দোলনকালীন ইত্তেফাকের পাতায় ছড়িয়ে আছে। এরমধ্যে একদিন ছাত্র জনতা কারফিউ ভঙ্গ করল। বাবা লিখলেন, ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের একাত্তরের ভূমিকা সম্পর্কে এভাবেই মূল্যায়ন তুলে ধরেন তার ছেলে নাসিম রেজা নূর। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেছে বেছে বুদ্ধিজীবী ও দেশপ্রেমিক মানুষদের হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও দেশীয় দোসরা। তাদের মধ্যে একজন সিরাজুদ্দীন হোসেন। কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করতেন না তিনি। মুক্তির অপেক্ষায় অধীর ছিলেন অকুতোভয় এই সাংবাদিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুনে যেতে পারেননি ‘জয় বাংলা’ সেøাগান। উপভোগ করতে পারেননি বিজয়ের আনন্দ। ১৬ ডিসেম্বরের একেবারেই আগ মুহূর্তে তাকে তুলে নিয়ে যায় ঘাতকরা। বিদায় বেলা পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন গামছা। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ॥ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কনস্যুলেটের গোপন একটি প্রতিবেদন ফাঁস করে আলোচনার ঢেউ তুলেছিলেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করছিল মার্কিন সরকার। সেখানে তাদের কনস্যুলেট থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরায় সেটা বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনেও রেখেছিল ব্যাপক ভূমিকা। ১০ ডিসেম্বর অন্তর্ধানের আগে একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের বিলম্ব মন্তব্য নিয়ে উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন তিনি। ওই রাতেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এই সাংবাদিককে, আর যে পাওয়া যায়নি তাকে। সিরাজুদ্দীনের ছেলে শাহীন রেজা নূর সম্প্রতি এক লেখায় বলেন, ‘১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর আল বদর ও আল শামস যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল, এর প্রেক্ষাপট বোঝা দরকার। ২৫ মার্চের ক্রাকডাউনে ঢালাওভাবে তারা বিভিন্ন জায়গায় মানুষ নিধন করে। গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করা এবং ভীত বিহ্বল করে দেয়া ছিল এর লক্ষ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তারা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে। প্রথমদিকে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। আর গেস্টাপো স্টাইলে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালায়।’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ॥ মুক্তিযুুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও বিশিষ্টজনদের দৃষ্টিতে দেশের সংবাদপত্র জগতের অন্যতম পুরোধা, মুক্তিযুদ্ধের নির্ভীক সৈনিক শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেন। পাকিস্তান আমলে যে কয়জন সাংবাদিকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তার ক্ষুরধার লেখার মাধ্যমে এ দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা অসাধারণ দক্ষতায় সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ষাট দশকের সব আন্দোলন, মি. জিন্নাহর নির্বাচন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালীদের অব্যক্ত কথা ইত্তেফাকের পাতায় মূর্ত করে তুলেছিলেন তিনি এমনই দরদ-মমত্ব আর পারঙ্গমতার সঙ্গে, যা এ দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ অধ্যায়রূপে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ এই দেশে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সে সময় তার লেখা ঠগবাছিতে গাঁ উজাড়, অধূনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায় ধরনের উপ-সম্পাদকীয় এবং এতদিনে শিরোনামে সম্পাদকীয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তার দৃঢ় অবস্থানের সাক্ষ্য দেয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ইত্তেফাক-এই কর্মরত ছিলেন। উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেছে, ১৯৫২ সালে দৈনিক আজাদের বার্তা সম্পাদক থাকা অবস্থায় মহান ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে তার বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে অসাধারণ কীর্তি বলে পরিগণিত। ব্রিটিশ আমলের শেষভাগ থেকে শুরু করে তার সাংবাদিকতা জীবন স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যাপ্ত। এই পুরো সময়কালে দেশের সব আন্দোলনের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি যোগাযোগ। তিনি তার ক্ষুরধার লেখার মাধ্যমে এ দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা অসাধারণ দক্ষতায় সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের অসাধারণ শিরোনাম বাঙালী জাতির রক্তে আগুন ধরিয়ে দিত। চিনিল কেমনে, সুকুইজ্জা কডে, জয় বাংলার জয়, অবশেষে বাংলার ভাগ্যাকাশ হইতে বাস্তিলের কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে, জনতার জয় হইয়াছে, বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন এবং দুই পাকিস্তানের ভারসাম্যহীনতাকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করে যে শিরোনাম করেছেন, তা পাঠককে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ১৯২৯ সালের ১ মার্চ তৎকালীন মাগুরা মহকুমার (বর্তমানে মাগুরা জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরুশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলবী মোজাহারুল হক। মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। এ সময় তাঁর চাচা মৌলবী মোহাম্মদ ইসহাক পিতৃহারা ভাইপো-ভাইজিদের দেখাশুনার দায়িত্ব নেন। তাঁর পড়াশুনার হাতেখড়ি চাচার কাছে। সিরাজুদ্দীন হোসেন ঝিকরগাছা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর যশোর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বিএ পড়া শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি দৈনিক আজাদ-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি আজাদ-এর বার্তা সম্পাদক হন। ১৯৫৪ সালে আজাদ-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর তিনি ঢাকার ইউএসআইএস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসবে কিছুদিন কাজ করেন। এক বছর পর ১৯৫৫ সালে তিনি ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ব্যক্তিগত জীবনে আট পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন বিনয়ী, সদালাপী, পরোপকারী এবং সজ্জন ব্যক্তিত্ব। তার স্ত্রীর নাম নূরজাহান সিরাজী। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নক্সার শিকার হন সিরাজুদ্দীন হোসেন। মুক্তির জন্য অপেক্ষা ॥ পান্না কায়সার সম্পাদিত ‘হৃদয়ে একাত্তর’ গ্রন্থে স্মৃতিকথা শিরোনামে বাবাকে নিয়ে নাসিম রেজা নূরের লেখায় বলা হয়, ‘৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ২/১ দিনের মধ্যেই পাকিস্তানী হানাদার বিমান বাহিনী সর্বস্বান্ত হলো মিত্র বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণে। ডিসেম্বরে নির্মেঘ আকাশে তখন মিত্রবাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্র। বাবা আমাদের নিয়ে ছাদে ওঠতেন। বিমান থেকে রকেট নিক্ষেপের দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠতাম সবাই। প্রাণের গভীরে যে আবেগ এতদিন প্রচ্ছন্ন ছিল তা বেরিয়ে আসতে চাইছিল। বাবা বলতেন স্বাধীনতা আর দেরি নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে বাধামুক্ত পরিবেশে নিঃশ্বাস নেয়ার আকাক্সক্ষায় তিনি ছিলেন উন্মুখ। যুদ্ধের সময় কেরোসিনের খুব অভাব ছিল। বাবা আমাকে নিয়ে একদিন সকালে ধানম-িতে আলোকচিত্র শিল্পী জহিরুল হকের বাসায় যান। সেখান থেকে ৬/৭টিন কেরোসিন আনি। তেজগাঁও বিমাবন্দরে মিত্রবাহিনীর অবিরাম বিমান থেকে শেল নিক্ষেপের দৃশ্য আমি নির্নিমেষ নয়নে দেখেছি।’ নাসিম রেজা নূরের লেখার আরও বলা হয়, সেদিন ১০ ডিসেম্বর। বাবা অফিস থেকে ফিরলেন বিকেলে। সেই বিকেলেই বড় দাদির বড় মেয়ে হেনা ফুফু ফুফা তাদের পরিবারকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসে উঠলেন। তারা থাকতেন তেজগাঁও বিমানবন্দরের কাছে। প্রচ- বোমা বর্ষণ ও শেল নিক্ষেপে টিকতে না পেরে তারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আমাদের বাসায় এসেছেন। মার শরীর ভাল নেই। রান্না বান্নাও সে রকম হয় না। এতগুলো মানুষের পরের দিনের নাস্তার জন্য চিড়া ভাজি আর মুড়ি আনতে বাবা আমাকে পাঠালেন। ফিরে এসে দেখি বাবার বন্ধু ডিএসপি তৌহিদ আলম কাকা বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। তার অফিস ছিল শান্তিনগর পোস্ট অফিসের পেছনে হোয়াইট হাউসে। শুনি বাবাকে সে রাতের জন্য কোথাও থাকতে বলেছেন। শেষ বিদায়ে গামছা চেয়ে নিলেন ॥ বাবা বললেন, আমার এতগুলো ছেলে তার উপর আমার বোন এসেছে আমাকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে। তাদের রেখে আমি তো যেতে পারি না। তখন কাকা যুক্তি দিলেন তার অফিসের একটা রুম বাবার জন্য ছেড়ে দেবেন যাতে আমরা সবাই মিলে থাকতে পারি। তবুও বাবা ঘর ছেড়ে থাকতে রাজি হলেন না। মুক্তি তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাবার সারা মন পড়েছিল আমাদের অতিক্রম করে তার হাজার বছরের লুণ্ঠিত, ধর্ষিত, অত্যাচারিত বাংলায়। সে দেশের মুক্তির পদধ্বনি তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্যোদয়ের। রাত এলো। আমরা সবাই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরলাম। তখন সবাই ঘুমোতাম মাটিতে রান্না ঘরে। বাবা অনেক রাত পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনলেন। শুনলেন বিবিসি। খেয়ে দেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। খুব ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। কান্নার শব্দ। খেয়াল করে শুনি মা কাঁদছেন। লাফ দিয়ে ওঠে পড়লাম। বসার ঘরে গিয়ে দেখি সবাই সেখানে। মেজ ভাই টেলিফোনে কথা বলছেন। সেজ ভাই বলল বাবাকে মুখে কাপড় বাঁধা ৪/৫ জন লোক এসে ধরে নিয়ে গেছে। বাবার সুখ দুঃখের সাথী মা চিৎকার করছেন আর বলছেন, এই শীতে শুধুমাত্র লুঙ্গি গেঞ্জি পরা অবস্থায় নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় একটি গামছা চেয়ে নিয়েছে। তোমাদের বাবাকে কোথায় নিয়ে গেল। বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে আপোস নয় ॥ ‘...খোন্দকার আব্দুল হামিদকে বাবার সম্বন্ধে বলা হলে জানালেন বাবা ভাল আছেন। কোন কাপড় চোপড় দেয়ার প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে তারাই ব্যবস্থা করবেন। মওলানা নুরুজ্জামানকে (নেজামী ইসলামীর নেতা রাজাকার সংগঠক, পরে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত) বাবার জন্য কিছু কাপড় পাঠানোর কথা বলা হলে একই উত্তর আসে। ভয় উৎকণ্ঠা বাবার জন্য দুঃশ্চিন্তায় কেটে যায় আমাদের দিন। আসে ১৬ ডিসেম্বর। দুপুরের পর থেকে হঠাৎ রাস্তায় বিচ্ছিন্নভাবে ‘জয় বাংলা’ শুনতে পাচ্ছিলাম। বিকেলের দিকে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে অলিগলি থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। জয় বাংলা ধ্বনিতে কেঁপে ওঠল সারা ঢাকা। আমি দৌড়ে এলাম বড় রাস্তায়। এত মুক্তিযোদ্ধা আর এত অস্ত্র ঢাকায় ছিল চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। খুশির সীমাহীন আনন্দে আমার প্রাণের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠলাম ‘জয় বাংলা’। ‘বাবা জাতির ভবিষ্যত নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন। তিনি বিকেলে বাসায় ফিরেলেই লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ত। জানতে চাইত কোন দিকে চলছে এ প্রবাহ। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। জাতি এ ডাকে সারা দিল। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে প্রকম্পিত হলো বাংলাদেশ। এ আন্দোলনের সময় প্রতিদিনই প্রায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ছাত্র জনতা নিহত হতে লাগল। বাবা ইত্তেফাকের পাতায় সে কাহিনী তুলে ধরতেন। স্বাধীনতাকামী বাঙালীর সঙ্গে এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন অকুতোভয়ে। যার প্রমাণ অসহযোগ আন্দোলনকালীন ইত্তেফাকের পাতায় ছড়িয়ে আছে। এরমধ্যে একদিন ছাত্র জনতা কারফিউ ভঙ্গ করল। বাবা লিখলেন, ‘ বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’। এরই মধ্যে এসে গেল ২৫ মার্চ। সেদিন দুপুরে বাবা খেতে আসেন বাসায়। একটু পরেই চলে যান অফিসে। স্বাধীনতার দাবিতে মুখর বাংলাদেশ। শোনা গেল মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক সফল হয়েছে। ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি। রাত ১০টার দিকে বাবা ফোন করলেন। জানালেন শহরের অবস্থা খুবই খারাপ। আলোচনা ভেঙ্গে গেছে। ইয়াহিয়া পাকিস্তানে রওনা দিয়েছেন। সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে ...’। বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিয়ে ছেলের লেখার আরও বলা হয়, ‘... ২৭ তারিখ কারফিউ উঠলে পুলিশ ও তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে যে দিতে পারল চলে গেল। বাবার খবর নেয়ার উপায় নেই। সকাল ১০টার দিকে বাবাকে আসতে দেখলাম। উনি হেঁটে হেঁটে আসছিলেন। সেই চির পরিচিত পায়জামা-পাঞ্জাবি আর পাম্পসু। বাসায় এসে বারান্দায় একটি চেয়ারে বসলেন। তাকিয়ে দেখি বাবা কাঁদছেন। এই প্রথম বাবাকে কাঁদতে দেখলাম। শত ঝড় ঝঞ্ঝা, প্রতিকূলতার মাঝেও যে বাবা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। তাকে আজ কাঁদতে দেখে খুবই অবাক হলাম। বাবা ভাবেননি আমরা বেঁচে আছি। রাজারবাগ পুলিশ লাইন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তিনি খবর পেয়েছিলেন। তার পাশেই আমাদের বাসা। তাই বাঁচার সম্ভাবনা সম্পর্কে বাবা নিঃসংশয় ছিলেন না। বাবা একটু স্থির হয়ে তার কাহিনী বললেন। বাসায় আমাদের সঙ্গে কলা বলার পর ফোন লাইন অচল হয়ে গিয়েছিল। বাবা তখন পরের দিনের পত্রিকা প্রকাশের কাজে ব্যস্ত। সর্বশেষ খবর পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করে পাকিস্তানীদের বিশ্বাসঘাতকতা আর ষড়যন্ত্রের কথা দেশবাসীকে জানাতেই হবে...।
×