ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গেইলের ক্যাচ মিসে ঘুরে গেল খেলা

গেইল ঝড়ে উড়ে গেল ঢাকা, নতুন চ্যাম্পিয়ন রংপুর

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

গেইল ঝড়ে উড়ে গেল ঢাকা, নতুন চ্যাম্পিয়ন রংপুর

মিথুন আশরাফ ॥ সবার মনেই একটি প্রশ্ন ছিল, পুরান না নতুন চ্যাম্পিয়ন মিলবে? বিপিএলের পঞ্চম আসরের ফাইনাল শেষে মঙ্গলবার সেই প্রশ্নের উত্তর মিলে গেল। নতুন চ্যাম্পিয়ন মিলল। ক্রিস গেইল এমনই ধামাকা দেখালেন, তাতে উড়ে গেল ঢাকা। গেইলের অপরাজিত ১৪৬ রানে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন ঢাকাকে ৫৭ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা ঘরে তুলল রংপুর। গেইলের মতো ব্যাটসম্যানকে ‘নতুন জীবন’ দেয়া মানে আগুনে পোড়ার মতো অবস্থা হওয়া। গেইলের মতো ব্যাটসম্যানদের সুযোগ দেয়া মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। সাকিব সেই কাজটিই করলেন। গেইল যখন ২২ রানে, তখন সাকিব ক্যাচ মিস করলেন। তাতে গেইল যেন আরও বিধ্বংসীরূপে ধরা দিলেন। ঢাকার ক্রিকেটাররা গেইল ধামাকায় শেষপর্যন্ত পুড়লও। গেইল শেষপর্যন্ত ৬৯ বলে ১৮ ছক্কা ও ৫ চারে অপরাজিত ১৪৬ রান করে দেখালেন। তার এ ত্রাসময় ব্যাটিংয়ে ১ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ২০৬ রান করে রংপুর। ম্যাককালাম অপরাজিত ৫১ রান করেন। দুইজন মিলে ২০১ রানের জুটি গড়েন। যা বিপিএল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জুটি হয়ে থাকল। এরপর ঢাকার ব্যাটসম্যানরা দলকে ১৪৯ রানের বেশি এনে দিতে পারেননি। ৯ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে এ রান করে ঢাকা। জহুরুল ইসলাম অমি সর্বোচ্চ ৫০ রান করেন। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটিতে উত্তেজনাকর লড়াই হবে, সেই আশা ছিল। লীগ শুরুর আগে যে দুই দলকে ‘কাগজে-কলমে’ সেরা ধরা হয়েছিল। সেই দুই দলই ফাইনালে ওঠে। ফাইনালে সমশক্তির দুই দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ দেখার আশা ছিল। কিন্তু রংপুর এত বিশাল রান করে যে, সেই রানে চাপা পড়ে যায় ঢাকা। এই রান অতিক্রম করতে হলে গেইলের মতো অতি মানবীয় ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যান দরকার ছিল। কিন্তু ঢাকা শুরুতেই ১ রানে দুই উইকেট ও ১৯ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়েই খাদের কিনারায় পড়ে যায়। আর ১০ রান যোগ হতেই যখন কাইরন পোলার্ডও সাজঘরে ফেরেন, ঢাকার হার যেন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অপেক্ষা থাকে, কখন ম্যাচ শেষ হবে। হারের ব্যবধান কত কমাতে পারবে ঢাকা। ৭১ রান হতেই সাকিব (২৬), ৭৪ রানে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, ৮৭ রানে শহীদ আফ্রিদি আউট হয়ে যান। এরপর জহুরুল ইসলাম অমি ও সুনীল নারাইন মিলে দলকে অনেকটা দূর নিয়ে যান। দুইজন মিলে ৪২ রানের জুটিও গড়েন। ১২৯ রান হতেই সুনীল নারাইন (১৪) আউট হয়ে যান। আরও ৩ রান যোগ হতেই হাফসেঞ্চুরি করা অমিও (৫০) অহেতুক বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরেন। শেষপর্যন্ত ১৪৯ রান করে ঢাকা। রংপুর শুরুতেই দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারের সেঞ্চুরিয়ান জনসন চার্লসকে হারায়। কিন্তু এরপর ক্রিস গেইল ও ব্রেন্ডন ম্যাককালাম মিলে উইকেটে জমে যান। তবে দুইজন উইকেটে থাকা মানে স্কোরবোর্ডে দ্রুতই রান ওঠা। সেটি শুরুতে হয়নি। স্পিন আক্রমণ দিয়ে গেইল ও ম্যাককালামকে চাপে রাখা হয়। যখন রংপুরের ২৮ রান থাকে, গেইলের ২২ রান হয়; তখন সাকিব গেইলের ক্যাচ মিস করেন। এরপরও ১০ ওভারে গিয়ে ৬৩ রান করে রংপুর। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, কতটা চাপে থাকেন গেইল ও ম্যাককালাম। দলের স্কোরবোর্ডে বেশি রান যোগ করতে হলে ছক্কা-চারের বাহার দেখানো ছাড়া আর কোন গতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে গেইল যেন সেই কাজটি করতে শুরু করে দেন। মারমুখীরূপে হাজির হন। ৩৩ বলেই ৫০ রান করে ফেলেন গেইল। খালেদ আহমেদের ১১তম ওভারের শেষ তিন বলে দুই ছক্কা, এক চার হাঁকিয়ে দ্রুতই হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন গেইল। গেইলের যেন ছন্দ এসে পড়ে। অসাধারণ ব্যাটিং করতে থাকেন গেইল ও ম্যাককালাম। ম্যাককালাম ১ রান করে নিয়ে গেইলকে ব্যাট করার সুযোগ করে দেন। গেইল ছক্কা-চার হাঁকাতে থাকেন। দেখতে দেখতে ১৫ ওভারে ১৩১ রান হয়ে যায়। ১৫তম ওভারের প্রথম বলে দলের ১১২ রানের সময় ২৭ রানে থাকা ম্যাককালামকে আউট করার সুযোগ পেয়েছিলেন আবু হায়দার রনি। কিন্তু ক্যাচ মিস করেন। এরপর টানা দুই বলে দুই ছক্কা হাঁকান গেইল। গেইলের ছক্কা বৃষ্টি যেন ঝড়তেই থাকে। দর্শক হয়ে তা দেখতে থাকেন ঢাকার ক্রিকেটাররা। দর্শক মাতেন আনন্দে। ৫৭ বলে ১১ ছক্কা ও ৪ চারে সেঞ্চুরি করেন গেইল। বিপিএলের এবারের আসরে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করেন গেইল। এলিমিনেটর ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পর ফাইনালে গিয়েও গেইল সঠিক সময়ে জ্বলে উঠেন। বিপিএলে তার এটি পঞ্চম সেঞ্চুরি। আবার বিপিএলে এক হাজার রানও পূরণ করে ফেলেন গেইল। টি২০ ক্যারিয়ারে এগারো হাজার রান করে ফেলেন টি২০’র রাজা গেইল। বিপিএলে ১০০ ছক্কাও হাঁকান গেইল। কী যে ব্যাটিং করতে থাকেন! সবাই অবাক দৃষ্টিতে দেখতেই থাকেন। ম্যাককালামও কম যাননি। তিনিও বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন। হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন। গেইল এমন ব্যাটিংই করতে থাকেন, টর্নেডো গতিতে রংপুরের স্কোরবোর্ডে রান যুক্ত হতে থাকে। এবার বিপিএলে এলিমিনেটর ম্যাচে অপরাজিত ১২৬ রান করে বিপিএলে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান করেছিলেন গেইল। ফাইনাল ম্যাচে সেটিকেও ছাপিয়ে গেলেন। ৬৯ বলে ১৮ ছক্কা ও ৫ চারে অপরাজিত ১৪৬ রান করেন গেইল। তিনি যে ১৮ ছক্কা হাঁকান, টি২০ ক্রিকেটে যে কোন খেলায় সবচেয়ে বেশি ছক্কা হাঁকান গেইল। বিশ্বরেকর্ডই গড়ে ফেলেন। তিনিই এর আগে ১৭ ছক্কা হাঁকান। সেটিকেও ছাপিয়ে যান। তার সঙ্গে ম্যাককালাম ৪৩ বলে অপরাজিত ৫১ রান করেন। তাতে দলের রান ২০৬ রানে যায়। দুইজন মিলে যে দ্বিতীয় উইকেটে ২০১ রানের জুটি গড়েন, সেটিও বিপিএলের সেরা জুটি হয়ে যায়। বিপিএলে সর্বোচ্চ রানের জুটি হয় এটি। শেষ ১০ ওভারে গেইল-ম্যাককালামের নৈপুণ্যে ১৪৩ রান করে রংপুর। বিশাল টার্গেট দাঁড় হওয়ার পরই যেন রংপুরের দিকে ম্যাচ ঝুলে যায়। শেষপর্যন্ত রংপুর চ্যাম্পিয়নও হয়। এর আগে বিপিএলে ২০১২ সালে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, ২০১৩ সালেও ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, ২০১৫ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স, ২০১৬ সালে ঢাকা ডায়নামাইটস চ্যাম্পিয়ন হয়। এবারও ঢাকা ফাইনালে খেলে। তবে নতুন দল হিসেবে ফাইনালে উঠে রংপুর। এবার চ্যাম্পিয়ন হয় নতুন দল রংপুরই। বিপিএলে নতুন চ্যাম্পিয়নও মিলে যায়। বরিশাল বার্নার্স, চিটাগং কিংস, বরিশাল বুলস ও রাজশাহী কিংসের পর এবার রানার্সআপ হয় ঢাকা ডায়নামাইটস। এরআগে টানা তিনবার (২০১২, ২০১৩, ২০১৫ সালে) চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। মাঝপথে গত আসরে সাকিবের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা ডায়নামাইটস। এক মৌসুম পর আবার শিরোপা হাতে তুলে ধরলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। পাঁচ আসরের মধ্যে চারবারই চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক হন মাশরাফি। এখন পর্যন্ত বিপিএলের ফাইনালে খেলে কখনোই হারেননি মাশরাফি। এবার নেতৃত্ব দিয়ে রংপুরকে চ্যাম্পিয়ন করালেন। তবে রংপুর যে চ্যাম্পিয়ন হলো তা গেইল ঝড়েই সম্ভব হলো। গেইল ঝড়েই যে উড়ে গেল ঢাকা। গেইল ঝড়েই যে চ্যাম্পিয়ন হলো মাশরাফির রংপুর। স্কোর ॥ ঢাকা-রংপুর ফাইনাল ম্যাচ-মিরপুর রংপুর রাইডার্স ইনিংস ২০৬/১; ২০ ওভার (চার্লস ৩, গেইল ১৪৬*, ম্যাককালাম ৫১*; সাকিব ১/২৬)। ঢাকা ডায়নামাইটস ইনিংস ১৪৯/৯; ২০ ওভার (মেহেদী ০, লুইস ১৫, ডেনলি ০, সাকিব ২৬, পোলার্ড ৫, অমি ৫০, মোসাদ্দেক ১, আফ্রিদি ৮, নারাইন ১৪, রনি ৯*, খালেদ ৮*; নাজমুল ২/৮)। ফল ॥ রংপুর রাইডার্স ৫৭ রানে জয়ী। ম্যাচসেরা ॥ ক্রিস গেইল (রংপুর রাইডার্স)।
×