ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণ

এ্যালান ক্যাম্বেল জনসন ছিলেন ভারতের শেষ ভাইসরয় স্যার মাউন্টব্যাটেনের প্রেস সেক্রেটারি। তিনি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকা- এবং তৎপরবর্তী সময়ে দিল্লীর পরিস্থিতি কি হয়েছিল, তা বর্ণনা করেছেন তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে। হত্যাকা-টি যখন সংঘটিত হয় তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বিবিসির সাংবাদিক বব স্টিমসন। গান্ধী হত্যাকা-ের খবর সর্বপ্রথম মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রচার করেছিল বিবিসি। এ্যালান ক্যাম্বেল জনসনের লেখা ‘মিশন উইথ লর্ড মাউন্টব্যাটেন’ নামক ডায়েরি থেকে অনুবাদ করেছেন, সাংবাদিক হাবিবুর রহমান স্বপন। নয়াদিল্লী, শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮ : এর মধ্যে একবার আগ্রা ঘুরে এসেছি সঙ্গে ছিলেন ‘নিউ স্টেটসম্যান এ্যান্ড নেশন’ পত্রিকার সম্পাদক কিংসলি মার্টিন। মার্টিন নেহরুর বহুদিনের পরিচিত বন্ধু এবং এই প্রথম ভারতে এসে তিনি নেহরুরই অতিথি হয়েছেন। দেখলাম আগ্রার তাজমহল। এর আগে বিমানযাত্রী হয়ে যাওয়ার সময় আকাশের উর্ধস্তর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে একবার তাজমহল দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। দেখেছিলাম ধবধবে সাদা চিনির খেলনার মতো ছোট্ট তাজ ঘোর সবুজের মধ্যে বসে রয়েছে। এবার তাজের দুটি নতুন রূপ দেখলাম। অপরাহ্ণের রক্তিম আলোকে প্রলিপ্ত তাজ এবং পূর্ণিমার জ্যোৎ¯œায় ¯œাত শুভ্রদেহ তাজ। পূর্ণিমা রাত্রির তাজ একটা স্বপ্নময় আবেশ সৃষ্টি করে ঠিকই কিন্তু তাজদেহের গঠনশৈলী দিনের আলোকেই দর্শকের চোখে একটা মধুরতার জাদু সৃষ্টি করে। আজ বিকেলে মাউন্টব্যাটেন তার দুই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাজ থেকে দিল্লী ফিরেছেন। লেডি মাউন্টব্যাটেন মাদ্রাজেই থেকে গিয়েছেন। মাদ্রাজ সফরও মাউন্টব্যাটেনের পক্ষে খুবই পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। বহু সংবর্ধনার অনুষ্ঠান তাকে সহ্য করতে হয়েছে। দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করতে হয়েছে এবং পথের দু’পাশে কাতারে কাতারে জনতা এক ব্রিটিশ গবর্নর-জেনারেলকে দেখার জন্য এসে দাঁড়িয়েছে। ৬টা বাজতে তখন মাত্র ১০ মিনিট বাকি, এ কী সংবাদ শুনতে পেলাম। এক দৌড়ে গিয়ে মাউন্টব্যাটেনের ডেপুটি প্রাইভেট সেক্রেটারি জর্জ নিকলসের ঘরে ঢুকলাম। নিকলস বললেন, গান্ধীকে হত্যা করার জন্য একটা চেষ্টা হয়েছে। গান্ধীর শরীরের তিন স্থানে গুলির আঘাত লেগেছে। আধঘণ্টা পরে মাউন্টব্যাটেনের গাড়ির ড্রাইভার পিয়ার্স বললেন-গান্ধী আর নেই, গান্ধী মারা গেছেন। পিয়ার্স তার গাড়িতে রেডিও থেকে এই সংবাদ শুনতে পেয়েছেন। পিয়ার্স বললেন, হিজ এক্সেলেন্সি এক্ষুণি বিড়লা হাউসে যাবেন। মাউন্টব্যাটেনের গাড়ির কাছে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘরের ভেতর থেকে মাউন্টব্যাটেন বের হয়েই আমাকে দেখতে পেয়ে ইসারায় জানালেন আপনিও চলুন। মাউন্টব্যাটেনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মুখের ভাব অত্যন্ত গম্ভীর ও কঠিন। বেশি কথা বলছিলেন না মাউন্টব্যাটেন এবং যা বলছিলেন তার ভাষাও কেমন যেন কাটা কাটা ও খাপছাড়া। মাউন্টব্যাটেন বললেন, এইমাত্র কলকাতা থেকে রাজাগোপালাচারী টেলিফোন করেছিলেন। নেহরুর নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন রাজাগোপালাচারী। মাত্র দু’দিন আগে অমৃতসরে এক জনসভায় নেহরু যখন বক্তৃতা করছিলেন তখন দুটো লোককে সভার মধ্যেই গ্রেফতার করা হয়। লোক দুটোর সঙ্গে হাতবোমা ছিল। মাউন্টব্যাটেনের ধারণা এবার ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ভয়ানক ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হলো। নেহরু এবার সম্পূর্ণভাবেই একা পড়ে গেলেন, অথচ এই ঘটনার সমগ্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার চাপ তারই ওপর এসে পড়বে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের সর্বত্র কি যে ভয়ানক ব্যাপার হয়ে যাবে তা বলা যায় না। এখন সব কিছু নির্ভর করছে নেহরুর ওপর। আর কয়েক ঘণ্টার মতো সমগ্র ভারতকে যদি এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া থেকে নেহরু বলিষ্ঠভাবে রক্ষা করতে পারেন তবেই মঙ্গল। মাউন্টব্যাটেন বললেন, এখন সব চেয়ে বেশি এবং সবার আগের প্রয়োজন হলো, সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে নেহরুর একটি ঘোষণা। এ বিষয়ে আর এক মুহূর্তে দেরি করা উচিত হবে না। কিন্তু নেহরুর যে চিন্তা করার জন্য একটু সময় চাই! জাতির উদ্দেশে নেহরু কি বলবেন সেটা নেহরুকে একবার ভেবে নিতে হবে। কারণ, সমগ্র জাতি এখন নেহরুর কাছ থেকেই কয়েকটি কথা শোনার প্রতীক্ষায় ব্যাকুল হয়ে রয়েছে। নেহরু এখন যা বলবেন, জাতি তাই মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। বিড়লা ভবনে পৌঁছলাম। ভবনের সম্মুখে ভিড় জমে রয়েছে। জনতা আমাদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল-কে এরা? জনতার ভেতর দু’একজন ছাড়া এ অন্ধকারে মাউন্টব্যাটেনকে কেউ চিনতে পারল না। জনতার মধ্যে ভয়ানক একটা উতলা ভাব ও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। জনতার পর জনতা ¯্রােতের মতো এসে বিড়লা ভবনের ওপর যেন আছড়ে পড়ছে। বিড়লা ভবনের দেয়ালের গায়ে কয়েকটি জানালার দিকেই সকল জনতার সমগ্র দৃষ্টি নিবন্ধ। বিড়লা ভবনের নিচের তলায় একটি কক্ষের অভ্যন্তরে ভারতের সকল মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতারা সকলেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নিষ্পলক তাঁদের চোখের দৃষ্টি। বেদনার আঘাতে যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন তারা। আমরা এগিয়ে গিয়ে গান্ধীর শয়নকক্ষের ভেতরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম জনা চল্লিশ ব্যক্তি এই ঘরের ভেতর রয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছেন নেহরু ও প্যাটেল। প্রত্যেকের চোখে জল। ঘরে ধুপের গন্ধ। ঘরের এককোণে গান্ধীর দেহ পড়ে রয়েছে। দশ-বারোজন মহিলা গান্ধীর মৃতদেহের কাছে বসে রয়েছেন। এদের মধ্যে একজন মহিলা গান্ধীর মাথার নিচে হাত দিয়ে গান্ধীর মুখ একটু উঁচু করে তুলে ধরে রেখেছেন। বড় একটা কম্বলে গান্ধীর দেহ আবৃত। মহিলাদের মধ্যে কয়েকজন আস্তে আস্তে স্তোত্র আবৃত্তি করছিলেন এবং কেউ কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। যেন পরম শান্তির মধ্যে ডুবে রয়েছে গান্ধীর মুখ। ওই মুখের ওপর এখন আর সেই সাদা ইস্পাতের ফ্রেমের চশমাটি নেই, যে বহু ব্যবহৃত পুরনো চশমাটি গান্ধীর চোখ মুখের প্রায় অঙ্গীভূত হয়েই গিয়েছিল। বাতাসে ধুপের গন্ধ, মেয়েদের করুণ কণ্ঠস্বরের কান্না ও প্রার্থনা, বৃদ্ধ মহাত্মার ক্ষুদ্র শীর্ণ ও নিষ্প্রাণ দেহ অথচ ঘুমন্ত মানুষের মুখের মতো শান্ত একটি মুখ এবং এত নীরব নরনারীর নিষ্পন্ন দৃষ্টি মনের সকল অনুভূতি মূহ্যমান করে দেয়ার মতো এমন বেদনাভিভূত মুহূর্ত আমার জীবনে আর কখনও দেখা যায়নি। মনের এমন আবেগ-ব্যাকুল অবস্থাও আমার জীবনে খুব কমই ঘটেছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ভবিষ্যতের কথা এবং ভাবতে গিয়ে শঙ্কিতও হয়ে উঠছিলাম। চিন্তাগুলো বিমূঢ় এবং দিশেহারার মতোই হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে মনের গভীরে এই সত্যও উপলব্ধি করছিলামÑ এটা পরাভাবের ঘটনা নয়, জয়ের ঘটনা। এই ক্ষুদ্রকায় মানুষটির চিন্তা আশা ও আদর্শের শক্তিই জয়ী হয়েছে। যে শুদ্ধ আগ্রহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে এই বৃদ্ধ নিশ্বাসের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার আদর্শের সেবা করেছেন, সেই শুদ্ধতা ও নিষ্ঠা এমনই এক শক্তি সৃষ্টি করে দিয়ে গেল যে, কোন হত্যাকারীর উদ্দেশ্য ও বুলেট সে শক্তিকে ছিন্ন করতে পারবে না। গান্ধীর দেহের নিকট দাঁড়িয়ে থেকে আমরা আমাদের নীরব শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। তারপর এ ঘর থেকে চলে গিয়ে বড় হলঘরের ভেতরে ঢুকলাম। সন্ধ্যা যত গভীর হচ্ছে ভিড় ততই বেড়ে উঠছে। জানালার ওপর শত শত মুখ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বন্ধ জানালাগুলোর শার্শি অনবরত ঝনঝন করে বাজছিল জনতার ব্যাকুল করাঘাতে। ভারত গবর্নমেন্টের মন্ত্রীরা অন্য একটি কক্ষে বসে রয়েছেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য হলঘর থেকে মাউন্টব্যাটেন এবার সেই কক্ষে গিয়ে প্রবেশ করলেন। আমি চুপ করে শুনছি। মাউন্টব্যাটেন বলছেন- গান্ধীর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাতের সময় গান্ধী আমাকে বলেছিলেন যে, নেহরু এবং প্যাটেলের মধ্যে সম্পূর্ণ মিল করিয়ে দেয়াই এখন তাঁর মনের সবচেয়ে বড় সাধের ইচ্ছা। মাউন্টব্যাটেনের কথা শেষ হওয়া মাত্র নেহরু ও প্যাটেল দুজনেই হঠাৎ উঠে পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং দুজনেই পরস্পরকে নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বিড়লা ভবনের কক্ষে সমবেত মন্ত্রীদের সঙ্গে কয়েক মিনিট আলোচনা করেই বের হয়ে এলেন মাউন্টব্যাটেন। মাউন্টব্যাটেন বললেন, প্যাটেলকেও রাজি করিয়েছি। আজ রাত্রে নেহরু ও প্যাটেল উভয়ে একই সময়ে বেতারে দেশবাসীর উদ্দেশে বলবেন। মাউন্টব্যাটেনের মতে, এই ব্যবস্থা করতে পেরে তিনি খুব বড় একটা সাফল্য লাভ করতে পেরেছেন। বর্তমান অবস্থায় রাজনৈতিক প্রয়োজনের দিক দিয়ে নেহরু ও প্যাটেলের এভাবে একসঙ্গে উদ্যোগী হওয়ার প্রমাণ দেশবাসীর সামনে প্রচারিত করা জাতীয় ঐক্যের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাউন্টব্যাটেন আবার বললেন, বর্তমান অবস্থার সকল ঘটনা ও প্রতিক্রিয়াকে নেহরু যদি অবিলম্বে আয়ত্তের মধ্যে আনতে পারেন, তবেই মঙ্গল। এ বিষয়ে নেহরুর সাফল্যের ওপরেই ভবিষ্যতের সব কিছু নির্ভর করছে। এখন দেশের সর্বত্র লোকের মনের ভাব এই শোকের আঘাত সত্ত্বেও এমন এক উত্তেজনায় কম্পিত হচ্ছে যে, সামান্য একটি কথার ভুলে অথবা একটি গুজবে এই উত্তেজনা দাবাগ্নির মতো জ্বলে উঠে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিছুক্ষণ আগে বিড়লা ভবনের সম্মুখে যখন আমরা ছিলাম তখনই ভিড়ের ভেতর থেকে একটা গুজববাজ লোক মাউন্টব্যাটেনের কাছে এসে বলে উঠল- একটা মুসলমান এই কা- করেছে। মাউন্টব্যাটেন এবং আমাদের মধ্যে কেউই তখনও জানতেন না যে কে হত্যা করেছে গান্ধীকে। হত্যাকারীর নাম কি? কোন ধর্মের লোক? এসব তখনও কিছুই আমরা শুনিনি। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন এটা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, হত্যাকারী যদি মুসলমান হয় তবে এ ঘটনার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া রুদ্ধ করার ভরসা আর নেই। সর্বনাশা গৃহযুদ্ধ নিরোধ করাও কিছুতেই সম্ভবপর হবে না। গুজববাজ লোকটার কথা শুনে মাউন্টব্যাটেন একটা বেপরোয়া আন্দাজের জোরে তৎক্ষণাৎ ধমক দিলেন-বেকুব কোথাকার। হত্যাকারী যে একজন হিন্দু এটুকুও এখনও শোননি? চলবে... লেখক : সাংবাদিক
×