ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খার্তুম এমন কোন ব্যথিত শহর নয় ...

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

রিপোর্টারের ডায়েরি

সুদানের রাজধানী খার্তুম এমন কোন ব্যথিত শহর নয়। মরু দেশ সুদানের খার্তুম নীলনদ ঘেরা। সৌন্দর্যের দিক থেকে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের শহরের মতোই। এখানে যুদ্ধ বিগ্রহের কোন ছোঁয়া নেই। এই শহরে ঘরবাড়ি, দালান-কোঠা, রাস্তা-ঘাট বেশ উন্নত। কারণ, খার্তুমে জাতিগত সংঘাত কখনই ঘটেনি। তাই খার্তুম বেশ গোছানো পরিপাটি। সেনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গত ২৩ নবেম্বর আমি এই শহরে পা রেখেছিলাম। রাতের শহর ছিল আলো জ্বলমলে। শহরের ঠা-া বাতাস গায়ে শীত এনে দিল। এয়ারপোর্ট থেকে বেশদূর গাড়িতে যাচ্ছিলাম। একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে মনে। দেশ থেকে যা ভেবে সুদানে পা রেখেছি তার কিছুই চোখে পড়ছে। শহরের ভেতর দিয়ে ৬ লেন-৮ লেনের রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে বাংলা হাউসের দিকে ছুটছে। ওই রাতেই বাংলা হাউসের দায়িত্বে থাকা মেজর শোয়েবের কাছে জানলাম। খার্তুম উন্নত একটি সমৃদ্ধ নগরী। এখানকার মিউজিয়ামে চার হাজার বছরের মমি রয়েছে। তাছাড়া খার্তুমে কখনও জাতিগত দাঙ্গা হয়নি। বশির সরকার খার্তুকে খুব গুছিয়ে উন্নয়ন করেছে। সুদানের ৫টি প্রদেশের মধ্যে খার্তুম সবচেয়ে উন্নত। এখানে ৬ থেকে ৭টি চেইন ফাইভ স্টার হোটেল রয়েছে। নীল নদ পুরো খার্তুমকে ঘিরে রেখেছে। পৃথিবীর যে কেউ এসে খার্তুমে নেমে বুঝবে না যে সুদানে গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে। হ্যাঁ সুদানের একটি প্রদেশ ‘দারফুর’ জাতিগত দাঙ্গায় পুড়ে ছাড়খার। মরু এলাকায় বছরের পর বছর মানুষের রক্তে নদী বয়ে যাচ্ছে। নীলনদের পানিকে সেখানে লাল হতে হয়েছে। এমন এক প্রদেশ হচ্ছে দারফুর। সুরক্ষিত খারতুম থেকেই দক্ষিণের মানুষগুলোর ওপর চালানো হয় শোষণ নিপীড়ন। চক্রান্তের জ্বাল এখান থেকেই ফেলে জাতিগত সংঘাত সৃষ্টি করা হতো। এখন হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হলেও শান্তি ফেরেনি দারফুরে। সেখানে প্রতিনিয়ত জাতিগত-গোষ্ঠীগত সংঘাত লেগেই আছে। বলা মুশকিল কখন শান্ত আর কখন অশান্ত। হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে উঠে দারফুর। খনিজ প্রধান এলাকা দারফুরে। কি নেই এখানে। হীরা, সোনা, জ্বালানি তেল, ম্যাঙ্গানিজ ইউরোনিয়াম থেকে শুরু করে যত খনিজ আছে তার প্রায় সবই দারফুরে। এ কারণে দারফুরের এলফাসার, নিয়ালা, জালিনজি, এলজেনিনা এই এলাকায় সংঘাত লেগেই আছে। রাতে মেজর শোয়েবের বর্ণনার পর পরেরদিন সকালে ৫৫ পদাতিক ডিবিশনের (যশোর) জিওসি মেজর জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল ইউএনের একটি ফ্লাইটে দারফুরের উদ্দেশে রওনা হলাম। ফ্লাইটে বসেই নানা জনের সঙ্গে কথা হলো। তারা দারফুর বিষয়ে অনেক কথাই বললেন। লে. কর্নেল গোলাম মোর্শেদ, মেজর সৈয়দ মশিহুর রহমান, মেজর জায়েদুল আলম, মেজর মোঃ আসাদুজ্জামান তাপস, মেজর মোস্তফা আহমেদ, মেজর মোস্তফা আহমেদ মোজাদ্দেদী, মেজর রাকীবুল আমিন ও আমি। প্রথমে আমরা গেলাম নিলায়া ক্যাম্পে। এখানে আমাদের স্বাগত জানান কন্টিজেন্টস কমান্ডার লে. কর্নেল সাদনাইন। তার আতিথেয়তায় আমরা মুগদ্ধ। রাতে ডিনারে সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের পরিবেশিত গান শুনলাম। তখন মনে হলো কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে এসেও নিজের দেশের মায়া অনুভব করছি। সেখানে আরেকটি বাংলাদেশ দেখলাম। ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত ক্যাম্পটি ঘুরে দেখতেই সব জায়গায় দেশের আমেজ খুঁজে পেলাম। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই কানে ভেসে এল ‘শোন একটি মুজিবের কণ্ঠ থেকে লাখো মুজিবের ধ্বনি’। গানটি বাজছিল মাইকে। এই গানের সঙ্গে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সকালের প্যারেট চলছে প্যারেট গ্রাউন্ডে। জানালা দিয়ে এ দৃশ্য দেখে মনটা ভরে গেল। পরে আরও অনেক দেশের গান মাইকে বাজছিল। একপর্যায়ে উঠে গেলাম প্যারেট গ্রাউন্ডে। দু’চোখ ভরে দেখলাম কমান্ডোদের প্যারেট। -ফিরোজ মান্না
×