ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যাচ্ছে বিদেশেও

তামার গহনা তৈরিতে সাভারে ৩০ গ্রামের মানুষের জীবিকা

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭

তামার গহনা তৈরিতে সাভারে ৩০ গ্রামের মানুষের জীবিকা

সৌমিত্র মানব, সাভার ॥ স্বর্ণ তো নয়ই, এমনকি রৌপ্যও নয়, তামা-পিতল দিয়ে তৈরি হচ্ছে গহনা। আর তা তৈরি হচ্ছে সাভার উপজেলার ভাকুর্তা ইউনিয়নে। উপজেলার এ ইউনিয়নটিতে রয়েছে ৩০টি গ্রাম। গ্রামগুলোতে বসবাস করা মানুষদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস হলো গহনা তৈরি করা। এখানে নারী-পুরুষ উভয়েই মিলে মেয়েদের জন্য গহনা তৈরি করে থাকেন। আর এগুলো বিক্রি হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া, এখানকার তৈরি গহনা বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। গহনার কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি বিভিন্ন গহনা। এ গহনার দোকানগুলোতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও কাজ করে উপার্জিত টাকা দিয়ে লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে। স্বর্ণ ও রৌপ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে সেগুলো দিয়ে তৈরি গহনা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকে। এখানে তামা ও পিতল দিয়ে তৈরি গহনাগুলো প্রাথমিকভাবে অপরিশোধিত অবস্থায় থাকে। এখান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সেগুলো কিনে নিয়ে পরিশোধন ও রং করে বাজারে বিক্রি করে থাকেন, যা সিটি গোল্ড বা ইমিটেশন নামে পরিচিত। এগুলো দেখতেও যেন সোনার মতো। প্রাথমিকভাবে ধরাটাও একটু কষ্টকর। এখানে তৈরিকৃত গহনাগুলোতে তামার ব্যবহারটা বেশি হলেও পিতলের সঙ্গে দস্তাও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখানকার কারিগরদের অধিকাংশই স্বর্ণ ও রৌপ্যের দোকানে কাজ করে গহনার বিভিন্ন ডিজাইনের কৌশল রপ্ত করেছেন। পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী গহনাও তৈরি করা হয়। ভাকুর্তা বাজারে বিভিন্ন পাকা, আধা পাকা ও টিনের ঘরের মধ্যে বসে কাজ করেন বিভিন্ন বয়সী কারিগর ও তাদের সহকারীরা। কারিগররা অত্যন্ত মনোযোগসহকারে তৈরি করেন নারীদের নাক, কান, গলা, পা, কোমর ও মাথায় ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের গহনা। স্বর্ণের দোকানে যে সকল ডিজাইনের গহনা থাকে, তার যেন সবই রয়েছে এ ঘরগুলোতে। সামনে, পিছনে ও দেয়ালে থরে থরে সাঁজানো বিভিন্ন ধরনের গহনা। গহনা তৈরির কাজটি আগে হিন্দুরা করতেন। মুসলমানরাও এটাকে এখন পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। গহনা তৈরিকারকরা জানান, তাদের তৈরি গহনাগুলো পাইকারিদের কাছে বিক্রি করা ২০ টাকা থেকে ১৫শ’ টাকা পর্যন্ত। ডিজাইন ও আকারের ওপর নির্ভর করে এর দাম। যেমন নেকলেস একশ’ টাকা থেকে এক হাজার টাকা, চুরি ২শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা জোড়া, সীতা হার ৬শ’ টাকা থেকে ১১শ’ টাকা, নূপুর ৩শ’ টাকা থেকে ৪শ’ টাকা, মাথার ঝাঁপটা ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা, হাতের মালতাশা ২শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা, খোপার কাঁটা ৩শ’ টাকা থেকে ৪শ’ টাকা, মাথার টায়রা ৩শ’ টাকা থেকে ৪শ’ টাকা, শাড়ির মালা ২৫০ থেকে ৫শ’ টাকা, নাকের ফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা, কপালের টিকলি ৮০ থেকে একশ টাকা প্রভৃতি। তারা আরও বলেন, এগুলো অপরিশোধিত অবস্থায় বিক্রি করা হয়। পাইকারি ক্রেতারা কিনে নিয়ে পরিশোধন করে যখন মার্কেটে বিক্রি করেন, তখন এর দাম হয় দেড় থেকে দু’গুণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় । এখানে গহনা তৈরির ৩শ’টির মতো দোকান রয়েছে। এবার একটু কম দামে গহনা বিক্রি হওয়ায় তারা লোকসানের মুখে পড়েছেন। এছাড়া, এখানে তৈরি গহনা এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। কারিগররা জানান, গহনা তৈরির কাঁচামাল তামা কিনে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর কোতোয়ালি থানার তাঁতিবাজার থেকে। দাম পড়ে প্রতি কেজি এক হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া, কিছু গহনার কাঁচামাল বগুড়া ও ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়। তারা নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করেন। দিনে ১৭/১৮ ঘণ্টা কাজ করে আয় হয় মাত্র ৪শ’ টাকা থেকে ৫শ’ টাকা। ভাকুর্তা বাজারের স্বর্ণ, রোপ্য ও ইমিটেশন ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন জানান, ভাকুর্তা বাজারের বয়স প্রায় দেড়শ বছর। এ বাজারে দোকান রয়েছে ৩শ’টির মতো। ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ এ পেশায় জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। এলাকার প্রায় প্রতিটি পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য এ পেশায় জড়িত রয়েছেন। আশির দশকেও এ বাজারে স্বর্ণ ও রৌপ্যের গহনা তৈরি হতো। কিন্তু, এগুলোর দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ী ও কারিগররা সেখান থেকে সরে আসেন। নব্বই দশকে এসে ঝুঁকে পড়েন ইমিটেশনের গহনা তৈরির দিকে। তিনি আরও বলেন যে, ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সব ইমিটেশন বা সিটি গোল্ডের গহনা বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই এখানে তৈরি হয়। এছাড়া, এ সকল গহনার সল্প সংখ্যক মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, ইতালি প্রভৃতি দেশেও রফতানি করা হয়। এরপরও তাদের আয় অনেক কম। সরকার যদি তাদের আর্থিক সহযোগিতা করত, তাহলে তাদের অবস্থা আরও উন্নত হতো।
×