ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আদালতের রায়ে বন্ধ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি

বিতর্কিত দারুল ইহসান ভার্সিটির সার্টিফিকেট বৈধতা পাচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭

বিতর্কিত দারুল ইহসান ভার্সিটির সার্টিফিকেট বৈধতা পাচ্ছে!

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বৈধতা পাচ্ছে আদালতের রায়ে বন্ধ হওয়া সেই বিতর্কিত ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট! সরকারের অনুমোদন ছাড়া শাখা ক্যাম্পাসের নামে দেশজুড়ে রীতিমতো দোকান খুলে সার্টিফিকেট বিক্রিসহ নানা অপকর্মের কারণে আদালতের আদেশে বন্ধ হওয়ার দেড় বছরের মাথায় রায়কে পাস কাটিয়ে সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সক্রিয় হয়েছেন মাউশির অসাধু চক্র। এরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি চক্রের যোগসাজশে হঠাৎ করেই বৈধতা দিতে ফাইল চালাচালি শুরু করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সোমবার এ সংক্রান্ত এক বৈঠককে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে কেউ কেউ আদালতের রায়ের পরও বিষয়টি বৈঠকে আনার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন, আদালত যাকে এক প্রকার নিষিদ্ধই করেছেন সে বিষয়টি নিয়ে আমরা কেন উল্টো পথে এগোচ্ছি। এক পর্যায়ে এ বৈঠকেই বৈধতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার উদ্যোগ এলেও অনেকের আপত্তির কারণে বিষয়টিকে শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবের অনুমোদনের জন্য রাখা হয়। অভিযোগ উঠেছে, পাঁচ গ্রুপে বিভক্ত দারুলের সনদের বৈধতা দেয়ার লক্ষ্যে মাউশির মাধ্যমিক শাখার কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন দারুল আহসানের একটি গ্রুপ। এরা যে কোন মূল্যে সার্টিফিকেটের বৈধতা নিতে মাউশিকে ম্যানেজ করেছে। মাউশির এ কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তিকেও ইতোমধ্যে পক্ষে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তারাই প্রকাশ্যে বলছেন, অনেকে সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি করছেন। এটা একটা মানবিক বিষয়। ডিজি স্যারও বিষয়টি বুঝতে পারছেন। সম্প্রতি এমপিও সংক্রান্ত এক বৈঠকে মহাপরিচালক দারুল ইহসানের সার্টিফিকেটের বৈধতা দেয়া পক্ষে মতো দেয়া নিয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। মাউশির কর্মকর্তারা রায়কে পাশ কাটিয়ে বৈধতার দেয়ার জন্য আইনী ফাঁক ফোকর খুঁজছেন বলে কদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছিল। তাই অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিলের আগে নেয়া সব সনদের বৈধতা দিতে চেষ্টা শুরু হয়েছে। বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে এক কর্মকর্তা বলেন, আজই বৈধতা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত প্রক্রিয়া একটু পিছিয়েছে। মন্ত্রী ও সচিবের কাছে বৈধতার জন্য ফাইল তোলা হবে শীঘ্রই। এ কর্মকর্তা বলেন, আসলে বৈধতার জন্য একটি গ্রুপ উঠে পড়ে লেগেছেন। যে তারিখেরই বৈধতা দেয়া হোক না কেন। বৈধতার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার অবৈধ সনদধারী তারিখ পরিবর্তন করে সনদ নিয়ে সরকারী সুবিধা দাবি করবেন। বৈধতা দিলে দেড় বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া সারাদেশের ভুঁইফোড় দোকানগুলো আবার সার্টিফিকে বাণিজ্য শুরু করতে পারবে। এটাই মূল লক্ষ্য। এদিকে দারুণ ইহসানের সব পক্ষের সনদের আনুষ্ঠানিক বৈধতা দেয়ার আগেই কিছু সনদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির এক শ্রেণীর কর্মকর্তা এই অপকর্ম করে যাচ্ছেন। দুদিন আগেই মাউশির উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) একেএম মোস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘আদালতের রায়ে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন গ্রুপের সনদ বাতিল করা হয়নি। এজন্য রায়ের আগে যারা সনদ নিয়েছেন, তাদের সনদের বৈধতার বিষয়টি সরকারের এখতিয়ার। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যই মন্ত্রণালয়ে সভা আহ্বান করা হয়েছে। সোমবারের বৈঠকে আদালতের রায়ে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট বৈধ কারার হঠাৎ উদ্যোগ নেয়ার কারণ কি? উপ-পরিচালক বলছেন, হ্যাঁ আদালতের একটা আদেশ আছে। আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালমা জাহানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু মাউশির অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালতের রায় যেভাবে আছে সেভাবে আমরা বলেছি। আলোচনা পর্যায়ে আছে। এর বেশিকিছু তিনি বলতে রাজি হননি। যুগ্ম সচিব সালমা জাহানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তবে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান আদালতের রায়ের বাইরে বা পাশ কাটিয়ে কোন পদক্ষেপের বিপক্ষে। তিনি বলেন, আমি বৈঠকে পুরো সময় থাকতে পারিনি। তবে দারুল আহসান নিয়ে আদালতের রায় আছে। সেখানে বিকল্প কিছু ভাবার সুযোগ নেই। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির চেষ্টা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, গত ১ নবেম্বর মাউশি মহাপরিচালক বরাবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুসরাত জাহান বানু স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, ‘পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলাধীন নওমালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে আদালতের (২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল) তারিখের আদেশের আগে যোগদানকারী এবং ২০০৮ সালের বিএড সনদ অর্জনকারী কেএম নাসির উদ্দীনকে এমপিওভুক্ত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। মাউশি অধিদফতরের কর্মকর্তারাও দারুলের সনদের বৈধতা দেয়ার কাজ শুরু করেছে। যদিও মন্ত্রণালয়ের একাধিক পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘এমপিওভুক্ত ও সরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবশ্যই সরকারী শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড কোর্স করতে হবে।’ এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেই এই শর্ত লঙ্ঘন করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠানো মাউশির একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলাধীন উত্তর রমজানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০১৫ সালের ২৫ মে যোগদান করেন। তিনি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক শাখা (ঢাকা) থেকে ২০০৮ সালে বিএড সনদ অর্জন করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক দারুল ইহুসান সনদ সংক্রান্ত (২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল) চূড়ান্ত আদেশের পূর্বেই তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এমতাবস্থায়, উল্লিখিত বিষয়ের আলোকে নিয়োগকৃত সহকারী প্রধান শিক্ষক সিরাজুল হকের এমপিওভুক্তির বিষয়ে পরবর্তী সদয় নির্দেশনা কামনা করে তথ্যাদি প্রেরণা করা হলো।’ মন্ত্রণালয় ও মাউশির এমপিও শাখার কয়েকজন কর্মকর্তাই জানান, ঢালাওভাবে দারুল ইহসানের সব পক্ষের সনদের বৈধতা দেয়া হলে এমপিওভুক্তি এবং সরকারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। কারণ কাগজ-কলমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম গুটিয়ে গেলেও পুরনো তারিখে এখনও সনদ বিক্রি করছেন কয়েকটি গ্রুপ। এ ধরনের সনদধারী ব্যক্তিরা নানাভাবে সরকারী সুবিধা পাওয়ার তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন। রাজধানীর ধানম-ির ৯/এ সড়কের ২১ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত ‘দারুল ইহসান ট্রাস্ট’র সচিব মাহবুব উল আলম তাদের ক্যাম্পাস থেকে প্রদান করা সব সনদের বৈধতা চেয়ে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য গত ২৭ সেপ্টেম্বর আবেদন করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এতে তিনি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাসকৃত শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটের (সনদ) বৈধতা প্রদানের দাবি জানান। জোনা গেছে, দারুলের পাঁচটি গ্রুপের মধ্যে ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দারুল ইহসানের তিনটি পক্ষের ১০৪টি ক্যাম্পাসকে অবৈধ ঘোষণা করে এগুলো বন্ধ করতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ এর আগে ৩৬ জেলার ১৩৫টি অবৈধ ক্যাম্পাস গুঁড়িয়ে দিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ‘মাউশির তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে মোট ৩২ হাজার নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় একটি করে লাইব্রেরিয়ানের পদ রয়েছে। এসব পদে প্রায় ১৩ হাজার নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিই দারুল ইহসানের সনদধারী।
×