ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

’১৮ সালের মধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের আশা করছি

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭

’১৮ সালের মধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের আশা করছি

ওয়াজেদ হীরা ॥ পার্বত্য এলাকার মানুষের জীবনসংস্কৃতি চিত্র ভিন্ন। পোশাক-পরিচ্ছেদেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। তাদের সেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনসংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচয় হওয়ার সুযোগ পায় সমতলের মানুষ। পরিচয়ের মাধ্যমটা হলো পার্বত্য মেলা। প্রত্যেক বছর পার্বত্য মেলার মাধ্যমে আদিবাসী-পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধন গড়ে ওঠে সমতল মানুষের। বিনিময় হয় পার্বত্য জেলার জনগোষ্ঠীর উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর। রাজধানীতে পাঁচদিন ধরে চলা এই মেলার পর্দা নামল সোমবার। মেলায় আদিবাসীদের পণ্য কেনাই প্রধান আকর্ষণ নয়। পণ্যের সঙ্গে বিনিময় হয় ভালবাসারও। এক অদ্ভুত মেলবন্ধনও তৈরি করে এই পার্বত্য মেলা। তাই তো পার্বত্য মেলায় প্রতিদিনই ছিল উপচেপড়া ভিড়। রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে পাঁচদিন ধরে চলা মেলার পর্দা নামার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙল আদিবাসী সংষ্কৃতি জানার মেলবন্ধনও। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় পঞ্চমবারের মতো এই মেলার আয়োজন করেছে। ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস উপলক্ষে এই মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মানুষের পদচারণায় মুখর ছিল মেলা। বৃষ্টিতে যদিও অন্যান্যবারের চেয়ে একটু থমকে গেছে এবারের মেলাটি। বিভিন্ন স্টলে বিকিকিনিও হয়েছে কিছুটা কম। বরাবরের মতো মানুষের আগ্রহ ছিল মেলাকে ঘিরে। এবারের মেলায় ৯২টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এসব স্টলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত ও তৈরি পণ্যের মধ্যে রয়েছে কৃষিজাত নানা পণ্য, বস্ত্র, মৎস্য, কুটিরশিল্প, খাদ্যসামগ্রী, নারী-পুরুষ, শিশুদের পোশাক, কসমেটিকস, অলঙ্কার, গৃহস্থালি পণ্যসহ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী। মেলার শেষ দিনে ঘুরে দেখা যায় নানা বয়সের বিপুল দর্শনার্থী-ক্রেতার সমাগম হচ্ছে মেলায়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও দর্শনার্থীর বিপুল সমাগম ঘটে। মেলায় অধিকাংশ স্টলেই মিলেছে পোশাক। সঙ্গত কারণেই শীতের পোশাকের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে; যার অধিকাংশই তাঁতে বোনা। চাকমা সম্প্রদায়ের নারীর ঐতিহ্যবাহী পোশাকের কারুকার্য দেখার মতো। গায়ে দেয়ার শালের বুননও বেশ মজবুত। রয়েছে বিভিন্ন রঙিন কাপড়ের পাহাড়ি ডিজাইনের জামাও। এছাড়াও পাহাড়ি কৃষিপণ্য ও ফলমূল দিয়ে সাজানো বেশ কিছু স্টল। যেখানে বাংলা কলা থেকে শুরু স্থান পেয়েছে বিন্নি চাল, জুমের আনারস, কমলা, বারোমাসি কাঁঠাল, নারিকেল, কচু ইত্যাদি। মেলায় আছে অনেক খাবারের স্টল। বিভিন্ন স্টলের ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে কেউ নিজেরা রান্না করে নিয়ে এসেছেন। আবার কোন স্টলে রান্না করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্টলে রয়েছে আঁখ। বাজারের আখের চেয়ে এটি একটু ভিন্ন। বেশ মোটা এবং এর রস বেশ মিষ্টি। পার্বত্য এলাকায় প্রচুর মসলা হয়, তাই মেলায় মসলারও কমতি নেই। খাগড়াছড়ি থেকে এসে মেলায় অংশ নিয়েছেন খোমা চাকমা। তার স্টলের নাম পাখড়া কৃষি পণ্য। এলাকার চাল, লাউ, কুমরা বিভিন্ন ধরনের সবজিসহ নানা জাতের কৃষিপণ্য তিনি বিক্রি করছেন। এসব পণ্যের বীজও রয়েছে তার কাছে। তিনি বলেন, চালের চাহিদা ছিল, বিক্রিও হয়েছে ভাল। এদিকে, আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘পার্বত্য অঞ্চলের ঝুঁঁকি: জলবায়ু, ক্ষুধা, অভিবাসন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় পাহাড় ধস, জুম চাষ ও বনায়ন পরিকল্পনার কথা জানান পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপরিকল্পিত’ বনায়ন করা হচ্ছে বলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ওপর ক্ষোভও ঝারেন তিনি। তিনি বলেন, কোথায় সম্পদ সৃষ্টি করবে, তা না করে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে বনায়ন করা হচ্ছে। কোথায় কোন্ গাছ কিভাবে, কতটা লাগানো উচিত তার কোন পরিকল্পনা নেই। পাহাড়ে ঘনবসতি ক্রমেই বাড়ছে বলে জানিয়ে বীর বাহাদুর বলেন, সবাই ভাবছে, পাহাড়ে এত বিরানভূমি পড়ে আছে, সেখানে জনবসতি স্থাপন করা যাক। কিন্তু সত্যি ব্যাপার হলো এখন পাহাড়ে জনসংখ্যা যা আছে, তা অতিরিক্ত। পাহাড়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে নিজস্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সুপরিকল্পিত চিন্তা প্রণয়নের কথাও জানান তিনি। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বান্তবায়ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। গওহর রিজভী বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের জন্য ওই সময় শেখ হাসিনার সরকার কাজ শুরু করে। কিন্তু মাঝখানে অন্য সরকার ক্ষমতায় আসায় তা আর হয়ে ওঠেনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে আবার কাজ শুরু করে। আমরা আশা করছি, ২০১৮ সালের মধ্যে পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন সচিব কাজী গোলাম রহমান, এসআইডি-সিএইচটি প্রজেক্টের চীফ টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট রাম শর্মা প্রমুখ। পার্বত্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ইতোপূর্বের মেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার বেইলি রোডে। এবারই প্রথম বড় আকারে শিল্পকলা একডেমির মাঠে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা আয়োজনে সহযোগী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইউএনডিপি, ব্র্যাক, ইউএসএইড, পদক্ষেপ, কারিতাস, হেলেন কিলার, মানুষের জন্য এবং ফাও। মেলা উপলক্ষে প্রতিদিন মেলাঙ্গনে একাডেমির উন্মুক্ত নন্দন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় পার্বত্য অঞ্চলের শিল্প, সংস্কৃতি, কৃষিসহ নানা বিষয়ে গান, নৃত্য, নাটক। উল্লেখ্য, জনজীবনে পর্বতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০০২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১১ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দিবসটি পালিত হয়।
×